যতটা উচ্চাশায় এই ভরা রোদের দুপুরে অ্যাডভেঞ্চারের নেশাকে বগলে নিয়ে এতদূরে এসেছিল তিতির, কোনোরূপ পরিকল্পনা ব্যতিরেকে, হুট করেই, স্বতঃস্ফূর্ত কবিতার শব্দের মতো মোলায়েম পদপ্রক্ষেপণে, ততটা আশাকে সে পুষ্পমাল্য পরাতে পারে নি, অর্থাৎ ভ্রমণটা সম্পূর্ণাঙ্গ হয় নি তার, গোটা বাগানে নতুন করে চিনবার মতো গাছ সে খুব কমই পেয়েছে, অবশ্য লিগুমেনুসি গোত্রের সেলটিস-খয়ের আর অজ্ঞাতকুলশীল আকাশমণি ও বুনোবুবির সাথে এখানেই তার প্রথম পরিচয়, পাম ও অয়েলপামের পার্থক্যটা এখানে না এলে কুয়াশাবৃতই থেকে যেত হয়ত, থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ গাছে কোনো নামফলক নেই, কিন্তু উদয়পদ্মের ঝোঁপে ছিল, আর এতে সে এমন আনন্দিত হয় যে, গোটা পৃথিবীটাই তার স্মৃতিতে চেনা-চেনা লাগে, এ জাতের পোড়ামাটিরঙা চামচসদৃশ বাঁকা মোটাপাতার গাছ তার প্রতিদিনের শহরে অনেক দেখেছে সে, যদিও নাম জানত না আগে, অনেক গাছের নাম-পরিচয় যেমন অন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনেছে, তেমনি এটিও সে জেনে নিতে পারত, কিন্তু মানুষের কাছে কত জিজ্ঞেস করা যায়, আর তাছাড়া জিজ্ঞেস করলেও উত্তর পাবার নিশ্চয়তা সর্বদাই হয় পঞ্চাশ শতাংশেরও নিচে, এটা সে এতদিনকার অভিজ্ঞতায় জেনেছে হাড়েহাড়ে, এটা খুব আত্মমগ্নতার কাল, সে জানে, এবং জিজ্ঞাসা শুনে কাঁচুমাচু শ্রোতার কাহিল অবস্থা দেখবার তার আর রুচি হয় না, এই অবস্থা দেখলে নিজেরই লজ্জা হয়
এসব নেশায় পাবার পর থেকে অভিজ্ঞতার্জনের পাশাপাশি একটা জরিপও সেরেছে তিতির, যার ফলাফল দেখে সে বিস্ময়ে ফালা ফালা, উদ্ভিদ সম্পর্কে ভালো জানেন, এমন মানুষ শয়ে মাত্র দু'জন, গাছপালা সম্পর্কে কিঞ্চিদধিক ভাবনা-চিন্তা করেন, এমন মানুষ শয়ে সাতজন, আর বাকি একানব্বইজন দু'পায়ে মাড়িয়ে যাচ্ছেন যাদের, জীবকুলে তাদেরও যে বাঁচবার অধিকার আছে, তাদেরও যে সুখদুঃখ আছে, ভাবেন না মোটেই, সে নিজে শয়ে দু'জনের কোটায় পদোন্নতি আশা করে, নিজেকে সে বৃক্ষের একজন উৎকৃষ্ট প্রতিবেশী ভাবতে চায়, তার মতে বৃক্ষ এখন অকৃতজ্ঞ প্রতিবেশী পরিবৃত, অথচ পৃথিবীকে আর কিছুদিন বাঁচতে দিতে চাইলে, উদ্ভিদের উৎকৃষ্ট প্রতিবেশী থাকাটা অতীব জরুরি, এহেন গণিতাচ্ছন্নতার এক পর্যায়ে হঠাৎ তিতিরের মনে পড়ে যায় কল্কেফুলের মতো হলুদ বয়সকে, সে বয়সের শাদা জবা চিনতে যাবার দিনের ঘটনাটা তাকে দোলায়িত করে আজো, কিছু-কিছু দিন থাকে কোজাগরী রাতের মতো স্মৃতিতে ডাগর, ওটা ছিল সেরকমই একটা দিন, কী রোদ সেদিন পথে-পথে, আকাশ চুঁইয়ে যেন আগুন ঝরছিল পৃথিবীতে বৃষ্টির ফোঁটার প্রায়, শাদা বাড়ির অনুষঙ্গে কী শাদাই না লাগছিল ফুলগুলি, নীল গেট, আহা নীল অপরাজিতা, আর সেদিন অনুপম ভাষায় কথা বলেছিল চুলের বেণী, পৃথিবী সেদিন তার দিকে অন্যরকমভাবে তাকিয়েছিল, সে অতঃপর ভয়ে-ভয়ে আনন্দে চিৎকার করে, জগতের সর্বাধিক স্বচ্ছন্দ কায়দায় জাপটে ধরেছিল ধরিত্রীকে কামার্ত কলায়
শাদার বন্যা ছিল সেদিন চারপাশে, পৌরপথগুলোও পিচের অধিক শাদা হয়ে উঠেছিল রৌদ্রনৃত্যে, এরকম হয় না সাধারণত, কিন্তু হলো, হঠাৎই রোদকে খুব অপ্রিয় মনে হলো তার, ভিটামিন ডি-এর জন্যে মৃদু রোদই যথেষ্ট, কেবল এর দোহাই দিয়ে, এত বৈরী যার আচরণ, খরখরে, আজ অন্তত মিত্র ভাবতে পারল না, বরং ছায়া দরকার, যদি চরম উত্তেজনাটা কোনো এক জায়গায় ব্যাহত না হতো, তবে রোদ মিঠা কী ঝাল কী টক, এ ভাবনার মনে উদয়ই হতো না, কিন্তু আসলে হয়েছে যখন, তখন সাপখোপের সম্ভাবনা টপকে, অপেক্ষাকৃত ঘন জঙ্গলে সে ঢুকে গেল ছায়াপাড়ায়, হঠাৎ নড়ে উঠল এক দঙ্গল ঝোঁপ, যার নিচে দু'জন মানুষ জাপটাজাপটি শুয়ে, একজনের পুরুষ্ট গোঁফ আরেকজনের স্তন, তিতির কথা বলে, পাখি আমি, ডালে ডালে ফিরি, আমাকে লজ্জার কী গো, তারা তখন শামুকের মতো গুটিয়ে এল পরস্পরের দিকে, হাঁফ ছাড়ল তিতির, তখন সে গোড়ানিমতলে, জামায় লেগে যাওয়া আলবিদার ডালটা ছাড়াচ্ছিল, বুনোফুল, আহা অনুপম, কী একটা জগৎ, এলেবেলে, আর বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎই নরোম কাদায় পা, এত নরোম যেন কিশোরীর স্তন, পা কেবল দাবতেই থাকল, দাবতেই থাকল
নদীর সাথে গাঙচিলের ভাবপর্বের সমন্বয়ক ছিপবাঁশের ছোট্ট সোনামণির মতো সুন্দর গোড়াটিতেই বসা ছিল ছেলেগুলো, তাস হাতে জনাচার, আর তাদের দর্শক হয়ে জনাতিন, কী যে হলো-না-হলো, সহসাই ওই ওঁৎসপ্তক চমকে দিয়ে গাছের সব পাখপাখালি, ঝাঁক ঝাঁক শকুনের মতো টাকি দৌড়ে ছুটল লিগুমেনুসি ঝোঁপটার দিকে, তিতির হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে চা গাছের পাতায় হাত বুলাতে বুলাতে ভাবল শকুনদের কথা, আচ্ছা, শকুনদের মরার অত নির্ভুল সংবাদ কে বা কারা পৌঁছে দেয়, মাছি না অন্য কেউ...
চা-পাতারা এর কোনোই জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করল না
No comments:
Post a Comment