শ্রেণিকরণ এমন এক সংকীর্ণতা যা সৃষ্টির মহিমাকে ম্লান করে দেয়

Categorisation Narrows the Glory of Creation. A composition of prose miscellany. প্রকাশক : প্রতীতি। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০০৩।

Friday, February 1, 2008

শৃঙ্খলিত জৈববৃত্তির ব্যাপারটা বেদনাউদ্রেকী

লাল গ্রাউন্ডের উপর সাদা কালিতে লেখা ‘রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী’র সাইনবোর্ডের একেবারে নাক বরাবর, মানে নাকের ছিদ্র দু'টো ঢেকে রাখা পুরানো পাঁচটি মালবাহী বগি, যেগুলো যৌনকর্মীদের ব্যায়ামাগার এবং যেগুলোর ধার কাছ দিয়ে গেলে বলবান দুর্গন্ধ সর্দারের হাতের টনী ঘুষিতে ছিটকে দূরে সরে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হয়, তার সামনেকার সরু প্ল্যাটফর্ম, যেটা এখন রেল-কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ব্যবহৃত হয় না এবং যেটা একই সঙ্গে উন্মুক্ত গণশৌচাগার, ঠিক সেখানটায়ই এক বিকেলে দেখা হয়েছিল, ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে দু’পা ফাঁক করে শুয়ে থাকা অবস্থায় আরেকজন স্টেশনবালাসহ, ঠোঁটের লাল টকটকে আগুন-রঙা লিপস্টিক, কপালের নীল টিপ, সাদা গ্রাউন্ডের উপর লাল ও বেগুনি প্রিন্টের জামা, লাল সালোয়ার ইত্যাদি ওর গায়ের কালো গ্রাউন্ডে অদ্ভুতদৃশ্য এক বর্ণবিভা ফোটাচ্ছিল, সূর্যের তখনকার ডিমের কুসুম-রঙা আলোর প্রেক্ষাপটে, আর ওই ঘাসের সবুজের

সে যাচ্ছিল ইসরাইলের সেলুনে, স্টেশনের মূল গেটের ডানপাশে, যেদিকে জোর করে খাইয়ে-দিতে-চায়-ধরনের অসহ বণিকদের পাঁচটি খাদ্যাগার, আর তার একটু সামনে বেকার কিশোরদের কেরামবোর্ডের আখড়ার পাশে রবীন্দ্রনাথের লম্বা দাড়ি-গোঁফওয়ালা বাঁধাই ছবিটার নিচের চেয়ারটায় বসে মুখের ভেতরে ঢুকে যাওয়া গোঁফগুলো ছেঁটে ফেলতে, যেগুলোর জন্যে প্রায়ই তার ভর্ৎসনা শুনতে হয় বিভিন্ন বয়েসী নারী-পুরুষের কাছ থেকে, অবশ্য নারীদের থেকেই বেশি, এমনকি প্রেম করবার সময়ও, বেলতলে, চা-খানায়, ঘরে-- তবে মাথার চুলগুলোর ব্যাপারে অত বেশি আপত্তি নেই কারো, যদিও অনেকে দূর থেকে আরেকজনকে দেখিয়ে মিটমিটিয়ে হাসে, কিন্তু এ বিষয়ক একখানি ওজনদার প্রশংসাও তার কানে ঢোল-সহরৎ করেছিল একদিন, কলেজ সেমিনারে, পরিচয়ের তৃতীয় দিনে, রানু নামের পানখোর গোলাপী মেয়েটির কাছ থেকে, বিকেলে, ক্লাসের ফাঁকে, কিন্তু এজন্যেই নয়, তার নিজেরও কিছু পক্ষপাতিত্ব আছে চুলদাড়ির প্রতি, নইলে দিনের-পর-দিন গিয়ে, পাঁচ বছরের মাথায়ও কাটিকাটি করে ওগুলো এ-যাবৎ কাটা যে হলো না, একথা তারই সবচেয়ে বেশি জানা, নইলে ‘আপনার চুলগুলো ত খুব ফাইন’ শুনেই, পেছনে আটআঙুল লম্বা চুল রাখতে তার বয়েই যেত, যেখানে উঠতি শ্যালিকা ও দুষ্টু কলিগেরা ফাঁক পেলেই, জোর করে ধরে মেয়েদের মতো ফিতা দিয়ে বেণী করে দিতে চায়

যে সন্ধ্যায় কথা হলো, সেদিন, এরা তিন ওরা চার, বসা ছিল নাগরের জন্যে উন্মুখ হয়ে, দক্ষিণের খোলা ঘাসের চাতালে, এমন ঋদ্ধ-সুন্দর চেহারার তিন-তিনটা যুবাপুরুষ দেখে, জিভে-নিভে দু'স্থানেই জল গড়াচ্ছিল ওদের, কিন্তু মুহূর্তমাত্রেই বুঝে ফেলেছিল দীর্ঘ অভিজ্ঞতাবশত যে, এরা আর যাই হোক অন্তত লাগাবার জন্যে আসে নি, মাগনা রসিক, এক-দু’বার হাত-টাত মেরে ফাঁক বুঝে চলে যাবে এক টাকাও না ধরিয়ে দিয়ে, ফলত একে একে সবাই ফুটে যাচ্ছিল স্থানটি ছেড়ে, যার-তার মতো ডান বা বাঁহাতে পাছায় থাপ্পড় দিয়ে, নতুন লাগা ধুলোগুলো ঝেড়ে ফেলে, কেবল একজন, যে বয়সে নবীন, রয়ে গেল, আগ্রহে গদগদ হেসে-খেলে, আর জিভে ও ঠোঁটে দরকার মতো রস ঝেড়ে ফোটাতে থাকল ভুরি ভুরি পিরীতের খই, এমনকি শেষে বুকে ও নিতম্বে হাত মেরে, কাড়াকাড়ি করে যেটুকু উষ্ণতা সম্ভব, নিয়ে, ঘণ্টাখানেক বাদে, ওর ইচ্ছাতেই বিনেপয়সায় চলে আসতে পেরেছিল এরা, সেই থেকে শুরু, যেখানে যেভাবে দেখেছে, দশজন-পাঁচজন নেই সবার সামনেই পাথর কয়লার মতো মুখে যথাসম্ভব হাস্যগুণ ফুটিয়ে ‘কেমোন আছেন’ শব্দে ঢেলেছে পরিচয়-রস, এমন তো নয় যে তার সবসময়ই এসব ভাবনা সঙ্গী, একদিন ইচ্ছে-টিচ্ছে করে তো ছয়দিন এসবকে বাজে মনে হয়, তাছাড়া এক-আধদিন তার সঙ্গে এমনও কেউ থাকেন, যার সামনে এরূপ অযাচিত কুশলাদি বিনিময় পর্বের অভিনয় রীতিমত ঝুঁকিপূর্ণ, এমনকি সঙ্গীজন ব্যাপারটাকে অন্যরকম ছন্দে অনুবাদ-টনুবাদ করে নিয়ে ভুল বুঝে বসতেও পারেন, কাজেই এ নৈমিত্তিক আছরটা স্টেশনে তার জন্যে আতঙ্ক হয়ে বিরাজ করছিল, তবু তার দিনানুদিনের ওভারব্রিজ-আরোহণে ব্যত্যয় ঘটেছে এমন নয়, কেবল স্টেশনে অমন কারোর সঙ্গে হাঁটাটা তাকে বাদ দিতে হয়েছে, যার সাথে সে অতটা ফ্রি নয়, এবং ওকে, মানে ময়নাকে এড়িয়ে চলার জন্যে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হয়েছে, কেবল যখন আপাত নির্জন ও নিরাপদ স্থানে সে থাকে, তখন চলন্তাবস্থায় ওর খবরাখবরটা নিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোনো আগাছার মতো যৌনবোধে তাড়িত হয়ে ওকে ঘিরে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না, যেখানে তার আসল যে কাজ, মানুষ দেখা, মানুষকে জানা, এটা সর্বদা ক্রিয়াশীল না রাখতে পারলে, এসব বাজে আচ্ছন্নতায় কোনো কাজে দেবে না, একথা, অন্তত বয়সের এ পরিণতিতে পৌঁছে, সে নিজে-নিজেই উপলব্ধি করতে বিশেষভাবে সক্ষম

একবার হলো কী, দু'নম্বর প্লাটফর্মে যখন বিনেপয়সার অপেক্ষমাণ যাত্রী ও উদ্বাস্তুদের চোখে কানা থালার মতো ভোর ভাঙছিল ফাল্গুন মাসে, তখন একজন উদ্বাস্তু পুরুষ আদি-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পাশেই শুয়ে থাকা একজন আলুথালু-বস্ত্রাকে চোখ বুঁজে গোটা শরীর দিয়ে চেপে ধরে, ততক্ষণে-যে জগৎটা রীতিমতো ফর্সা হয়ে গেছে, এ খবর রাখবার তার কোনো মতি ছিল না, তো দিনের ফর্সা হয়ে যাওয়া অথবা অনভ্যাস, যে কারণেই হোক, এক ঝটকায় উঠে বসে মহিলাটি প্রাকৃত বাংলায় পুরুষটিকে এমন গালাগাল দিতে থাকল যে চারপাশে বেশ লোক জমে গেল, এরকম পরিবেশে ময়না বা ওর সমগোত্রীয় কারো থাকবার কথা নয়, ওরা স্টেশনের প্রভাবশালী স্থায়ী বাসিন্দা, নিশিযাপনের জন্যে এরচে’ আড়াল ও আরামপ্রদ জায়গাগুলোই ওদের দখলে, কাজেই ময়নার দেখে ফেলবার ভয় নেই মনে করে ঢাকাগামী ভোরের ট্রেনের অপেক্ষায় থাকতে-থাকতে আদি-ঝগড়ার ব্যাকরণ শিখবার কাজে মনোনিবেশ করল সে, কিন্তু হায়, এখানেও ময়না, রেলবগির আড়াল থেকে দিনের প্রথম খেপটি মেরে বেরিয়ে এসেই বীরের মতো একেবারে ঝগড়াস্থলের মধ্যবিন্দুতে হাজির, সে লোকজনের ভিড়ে মুখ লুকিয়ে কোনোভাবে ময়নার চোখ থেকে নিজেকে রক্ষা করে, কামুক লোকটা তখন রীতিমতো নিস্তেজ, মহিলাটি যেভাবে তার মায়ের সাথে বোনের সাথে মুখে-মুখে তাকে শুইয়ে দিচ্ছিল বারবার, তাতে তার উত্তেজনা যে উলটোমুখে ধাবিত হবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ময়না তা হতে দেবে বলে মনে হলো না, বাঁহাত দিয়ে লোকটাকে ধরে তার কাছে দশ টাকা আছে কি না জানতে চেয়ে, নেতিবাচক জবাব পেয়েও, ‘বে-জা’গায় হাত মারো কেন বাবা, আস তোমার গরম কমাইয়া দেই’, বলে, টেনে রেলবগির পেছন দিকটায় ছুটলে ওকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে তার, সেটা এজন্যে যে, আজ-বসন্তে উদ্বাস্তু লোকটার একজন বিপরীতলিঙ্গীর স্পর্শ সত্যিই দরকার ছিল, টাকা নেই বলে তার সে দরকার অদরকারে পরিণত হয়ে যাবে, এটা ময়না পেশাদার একজন হয়েও মেনে নেয় নি

সাতপ্রস্থ রেললাইন, খানপাঁচেক সচল-অচল মালগাড়ি, নতুন পুরাতন গু-মুত মিশ্রিত জটিল দুর্গন্ধ পেরিয়ে, ডানদিকের কারখানায়, সেদিন দু'জন মিলে তারা ঢুকে গিয়েছিল স্থলচর শামুক কুড়াতে কুড়াতে, আরেকটু বেশি হেঁটে পূর্বদিক থেকে, দু'টো বিধ্বস্ত রেলগাড়ির ফাঁক দিয়ে লম্বা ঘাসে মোড়া বিপজ্জনক পথে, যেদিকে প্রায়ই দেখা মেলে বিষধর সরীসৃপের, জোঁকের উপদ্রব তো আছেই, তদুপরি আছে আর্থ্রোপোডা পর্বের বিভিন্নাকৃতির পোকা, আর ঢুকেই, তোতলা গার্ডটার উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে, পছন্দমতো একটা মোটামুটি পরিচ্ছন্ন কামরায় বসে, এদিক দিয়ে আসার যৌক্তিকতাটা নতুন করে যাচাই করে নিল, অন্তত ভেতর দিকে ঢুকতে দেখেই যারা মনে করে, বাজে মেয়েদের কাছ থেকে মাত্র পাঁচ টাকায় সঙ্গমসুখ কিনতে যাচ্ছে, তাদের কবল থেকে নিষ্কৃতি পাবার এ প্রক্রিয়াটার কোনো বিকল্প আপাতত খুঁজে না পেয়ে, মনে স্বস্তি নিয়ে তারা পুকুরের দিকে তাকাল, যেখানে প্রায় ন্যাংটো হয়ে স্টেশনবালারা স্নান সারে, শাড়িসায়া খুলে-কেচে আগে ভাঙা বগিতে শুকাতে দিয়ে, পরে, দীর্ঘসময় ধরে যত্ন করে নিজের উদোম শরীরের বিশেষ-বিশেষ স্থানে বিশেষ-বিশেষ কৌশলে মাজন পরিচালনা করে, এর সবটাই যে দেহের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যে, কস্মিনকালেও ব্যাপারটা এরকম নয়, বরং দিবালোকমণ্ডিত অলস সময় ক্ষেপণের জন্যেও বটে, যাহোক, ওপাশে রেলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসমেত জামাতে দাঁড়িয়ে এসব স্নানাচারাশ্রিত কাণ্ড কারখানা বিনা টিকিটে উপভোগ করে অশেষ সওয়াব হাসিল করে আসছে সেই আদ্যিকাল থেকে, বংশানুক্রমে, সে বিরক্ত হয় সহসাই, তোতলা গার্ডটার অনর্থক এটা-ওটা প্রশ্নে, যার এক-দু'টার জবাব ইতোমধ্যে সঙ্গের জন করুণা করেছে, সে চাচ্ছিল মস্তিষ্কের ভাবনাটার কী করে পরিপূর্ণতা দেয়া সম্ভব, কিন্তু লোকটার ক্রমবর্ধমান তোতলামি তাকে অত্যাচারিত করছিল, অবশ্য এরকম ঘটনার সাথে সে বেশ পরিচিত, শুধু সে কেন, প্রায় সবারই কমবেশি এতদবিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে যে, বিরক্তির কথা বলাও যাচ্ছে না, আবার বকবক সহ্যও করা যাচ্ছে না, এসব ক্ষেত্রে সে নীরবতার চাবুকে ওঠায় উদ্দিষ্টজনের পিঠের চামড়া, এক কথার জবাব দিয়ে, আরো পাঁচ কথা বলার সুযোগ করে দেবার মতো বোকামি সাবালক হবার পর থেকে সে আর করছে না, তবে একে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেবার চেষ্টা করাও এক ধরনের বোকামির পর্যায়ে পড়ে, কেননা তাদেরকে এখান থেকে বিনাশর্তে তাড়িয়ে দেবার অধিকার গার্ডটি সংরক্ষণ করে, তার এ ক্ষমতাটাকে, এ মুহূর্তে বাহ্য-আচারে হলেও সম্মান প্রদর্শন করে যাওয়ায় কিছুমাত্র আত্মপ্রতারণা থাকলেও নগদ কোনো ক্ষতি নেই, এবং কী কাণ্ড, হঠাৎ বৃষ্টি, আর ঝুতঝুতি পুকুরপাড় থেকে স্নানার্থী স্টেশনবালারা এসে কামরাটাকে মোটামুটি জনাকীর্ণ করে দিল, এটি আরো বিস্ময়ের যে তাদের ভেতর ময়নাও ছিল, সদ্যস্নানা, ঢুকেই, ‘কেমোন আছেন’ এবং ‘এ-জন আমার মা, নিতে আসছেন, আমার বিয়া ঠিক হইছে’, বলে ও থামতেই, ইশারায় কাছে ডেকে ডাইনির মতো চেহারার সেই বুড়ি ময়নাকে শাসাল পরপুরুষের সাথে কথা বলার অপরাধে, বুড়ির ভড়ং দেখে তার প্রথমত রাগ হয়, তবে পরক্ষণে ঘটনাটা তাকে এমনভাবে বিস্মিত করে যে, সে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, জোরে হাসতে চেয়ে পারে না, বুড়িকে উদ্দেশ্য করে একটা ন্যাংটো কথা বলতে চায়, তা-ও পারে না, শেষে এই ঝাল গায়ে মেখেই ডুব দেয় অন্তর্গত হ্রদে, যে-কেউ যদি ময়নাকে বিয়ে করতেই চায়, তবে ওর খুচরো রেটে দেহ বেচে খাবার কোনো যুক্তিই নেই, বিয়েতে ওর সম্মত হওয়া উচিত, সে এই সিদ্ধান্ত নেয়, ময়নাকে বলে দেবে যে, ও-যেন কালবিলম্ব না করে দুয়েকের ভেতর ওর মায়ের সঙ্গে চলে যায়, কিন্তু ওই মা মহিলাটির এ কী আচরণ, বছরের অধিক কাল থেকে যে মেয়ে স্টেশনে গণহারে দেহদানে প্রবৃত্ত আছে, সে একজন পুরুষের সাথে কথা বললে তার সহ্য হচ্ছে না, এ ঘটনাটাকে ‘চরম ফাজলামো ছাড়া আর কিছু নয়’ বলে মনে হয়, তার খুব জানতে ইচ্ছে করে যে, এতদিন মেয়ের খোঁজখবর করার ভার মহিলাটি কার ওপর ন্যস্ত করে রেখেছিল, কিন্তু বৃষ্টি থামে এবং বুড়িসহ একে-একে সাতজন ধরেই কামরা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায়

অন্যদের উপার্জন এ সপ্তাহে যাই হোক ময়নার মোটেই হয় নি, ও স্টেশনে ছিলই না, সম্ভবত ওর মায়ের সাথে বাড়ি চলে গিয়ে থাকবে, এবং এটা সে খুব বুদ্ধিমতির মতো কাজ করেছে, সুযোগ পেলে ময়নাকে বাড়ি চলে যাবার পরামর্শ দেবার সিদ্ধান্ত সে নিয়েওছিল, কিন্তু পরামর্শ ছাড়াই যখন গিয়েছে, তখন ব্যাপারটা ভালোর ওপর ভালো, যারা এখনো স্টেশনে থেকে গেছে, তাদের মস্তবড়ো একজন প্রতিদ্বন্দ্বীও এ সুযোগে কমল, এ অর্থে তাদের খুশি হবারও যথেষ্ট কারণ আছে, তবে স্টেশনে যে একহালি বোবা মেয়ে আছে, দেহ ব্যবসায়ী, ওরা দারুণভাবে খুশি হয়েছে ময়নার চলে যাওয়ায়, নির্বাক বলে ওদের প্রচুর অত্যাচার সইতে হয় সবাকদের থেকে, বিশেষ করে ময়নাটা কী জানি কী জন্যে, ফাঁক পেলেই এদের পিঠে বসিয়ে দিত দপাদপ দু'চার ঘা, আর ওরা বাজখাই গলায় চিৎকার জুড়ত কুকুর ছানার মতো, অন্যকেউ, অপেক্ষমাণ যাত্রী কিংবা পকেটমার এসে ওদেরকে সাময়িকভাবে উদ্ধার করত, এসবের থেকে বেশি আলোচ্য বরং এ সারকথাটি যে, ওদের একটা নৈমিত্তিক ফাঁড়া দিনকয় থেকে আর দেখা দিচ্ছে না, কিন্তু আট নম্বর দিন, নতুন শাড়ি পরা ময়নাকে স্টেশনে দেখে, বোবাহালির মতো আতঙ্কবোধ না জাগলেও সঙ্গত ও সংক্ষিপ্ত একটা প্রশ্ন জাগে তার মনে, এবং যার উত্তর জরুরি ভিত্তিতেই জানা দরকার মনে হয়, এটা জানার আগে তার অন্যসব কামকাজ, যা করবার জন্যে সে যাচ্ছিল, আপাতত স্থগিত ঘোষণা করে সে, তার জরুরি যে কাজ, বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠি পাঁচটিতে ডাকটিকিট লাগিয়ে অথবা ফ্রাঙ্কিং করে আরএমএস-এর গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া, তা ঘণ্টাখানেক পরে করলেও মহাভারত অশুদ্ধ হবার সম্ভাবনা নেই, ভেবে, লোকজন না ডরিয়ে সে Mymensingh JN লেখা বিশাল সাদা সাইনবোর্ডের কাছে দাঁড়ানো ময়নার কাছে গিয়ে, ‘ময়না যে’ বলে দাঁড়াতেই, ‘কেমন আছেন’ দিয়ে শুরু করে ও জানাল যে, ওর বিয়ে হয়েছে, কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছিল, কেননা বিয়ে হলে ওর এখানে ফিরে আসার সম্ভাবনাটাকে মন বারবার নাকচ করে দিচ্ছিল, এবং সে ভাবল, আরেকটা প্রশ্ন এখন খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, স্বামী বেচারা ব্যাপারটা বুঝলে তার ক্ষতি-টতি হবে কি না, জানতে চাইলে, ময়না তাকে বিস্ময়ের আঘাতে ভাঙচুর করে দিল এই বলে যে, ওর স্বামীই ওকে এখানে পাঠিয়েছে নয়া সিফনটা পরিয়ে, এবং এখন থেকে ওর আর খোশগল্পে সময় নষ্ট করলে চলবে না, দিনান্তে স্বামীর হাতে ছয় ইঞ্চি দীর্ঘ একটা কমলা-লাল নোট গুঁজে দিতেই হবে

Thursday, January 31, 2008

বৃত্ত ও বৃত্তাবদ্ধতা বিষয়ক একটি আক্রোশের সরল অনুবাদ

চুন বেশি হয়ে যাওয়া বড়ো পানটি মুখে পুরে ধীরে ধীরে সড়ক পেরিয়ে অ্যাকেশিয়া গাছটার গোড়ায় দাঁড়িয়ে গমনপথের দিকে মুখ রাখলে বাঁহাত যেদিকে থাকে, তাকাবার প্রয়োজনে সে অনুভব করে যে মেপে দেখা দরকার কত দূরত্বে ভাবনা রেখে এল, তারপর অর্ধেক পথ ভাবতে-ভাবতে এগিয়ে, বাড়িটা পর্যন্ত আসতে দু'ভাগে সাত-আটটা তরতাজা যুবক দেখে সে, তখন গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল মাসুদ, এইমাত্র ওর পালা শুরু হয়েছে, জামাল উদ্দিন, যে আগের পালার, ওর ডিউটিকালেই বাইরে বেরোয় সে, ডানদিকের পুরানো বাড়ি দু'টোর সামনে দিয়ে, যেখানের ঠিক উলটোয় পুরানো রহস্য লুকানো, তার অন্তে আধমতো অন্ধকারে দু'টো বয়েসী যুবক ড্রেনের পুলে পা ঝুলিয়ে বসা ছিল, সোজা মুখে, খুব স্বচ্ছন্দে বাঁদিকে হাঁটা ধরল সে আলো-সন্ধানে, পথে সজনে গাছের অন্ধকারে দু'টো বালিকার গা ঘেঁষা খায় সে, পাশে সবাই টিভিতে মগ্ন প্যাকেজ নাটকে, জানালার পর্দা কাঁপিয়ে বাজে সব চিৎকার এসে কানে বিঁধছিল তার, শেষে ড্রেনটি ডিঙানোর পরেও পাঁচটি কিশোরীকে ডিঙাতে হয়, তখন কালো ঘনপিচ-রহস্য ঘেঁষা অন্ধকারের ঝাঁঝমাখা আলো ভ্রূ-ঝাপসা চোখেও বেশ আন্দাজ করা যাচ্ছিল, ডানপাশে রোল করা প্যাডের মতো অজস্র রাস্তার একটির কোনায় আট-নটি বখে যাওয়া পোলা ঢেঙা করছে, অথচ তার আগেই সে রহস্যে সেঁধেছে, কিশোরীদের পরেই, সজনে গাছের গোড়া থেকেই যার প্রস্তুতি শুরু, এবার ঠিক রাস্তার বিপরীতে, প্যাডের বিপরীতে, সে খুব করে কুতিয়ে কুতিয়ে মুতে নেয়, হাত দুই উঁচু নির্মাণাধীন বিল্ডিং-এর পাশের অন্ধকারে, যেখানের ঠিক পিছেই বখাটে যুবারা, তার মনে হলো, ফাঁদ পেতে আছে লোকটা, হিসুকালে যে ডানপাশের নির্মাণাধীন ভবনের দু'হাতে বসা ছিল শাদা-জামা-পরা, শাদাকে কেননা অন্ধকারেও চেনা যায় ঠিকঠাক, সে সবটা ডুবছিল ততক্ষণে, এদিকে ইনডোরের আলো ফুরিয়ে যায়, ওদিকে ময়লা অন্ধকার, ডুবতে হবে তার ভেতরেই, এবং সঙ্কোচও লাগছিল কিছু ছেলেটাকে, বস্তির ওপাশ থেকেই যে হাঁটতে লেগেছে, তাঁকে ডিঙিয়ে যেতে মনে হয় যে, রহস্যের গন্ধটা সে টের পেয়ে যাবে, তবু পেরোল সে, বাতাসে খোলামেলা শুয়ে থাকা মহিলা ও শিশুদের একটিকে প্রায় মাড়িয়ে

আজ কোনো কাজ ছিল না শুধু আলসেমি ছাড়া, যদি-বা আলসেমিকে কোনো কাজ ভাবা যায়, অবশ্য বেরোবার আগে সে একপ্রস্থ চাষ সেরেছে নাছোড় দিনপঞ্জির পাতায়, কেননা এর হাত থেকে তার কোনো রক্ষা নেই ইহকালে, যা সে ইতোমধ্যেই খুব করে বুঝে গেছে, যাহোক, ভ্রমণের ত্রিভুজে পা দেবার কিছু পরেই সে বাহ্য রহস্যে সেঁধিয়ে ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় ডানপাশের পথে, মন টানে যেদিকে রঙিনবাতির দপদপ, তার ঠিক আগেই বোধ হচ্ছিল যে সে ভুল করেছে, ঠিক তৃতীয় ভুজের পেছনে বর্ধিত রেখা বরাবর না গিয়ে, যেদিকে কাঁচাবাজার দাঁড়িয়ে সবজির তাজাঘ্রাণ গায়ে মেখে, ওদিকে না-হাঁটা পথ, অচেনা-গুরুত্ব আছে, তাই তার মেজাজ স্থাপিত ডানে, কেননা পেছনে ফেরা তাকে দিয়ে হবে না, ওইসব ভণ্ডামি করে কোনো লাভ নেই, বরং এই ভালো, সামনে যা কিছু, সামনের ডানদিকে লাল-লাল নীল-নীল পাঁচতলা, হলুদ গ্রাউন্ডে ঝকমকিয়ে উঠছে এবং রঙের রূপকথা ঝুলিয়ে রেখেছে গোটা দেহে, ভারি সুন্দর করে রাহস্যিক আঁচড়ের মাঝখানে ‘কেয়ার হলুদবরণ’ শীর্ষক ত্রিভুজটি সাঁটিয়ে দিয়েছে কাপড়ের গেটে, নিচে, কিছুটা ভেতরে মুখরা দু'টো শাদা গাড়িকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে এখানে, কেননা ‘হলুদবরণ’ মানে দু'টো বিপরীতধর্মী যৌনাঙ্গধারীর মধ্যে একজীবন ধরে সাধনযোগ্য একখানি বয়স্ক দলিলের মহড়া, কিন্তু এই যে এতক্ষণে মনে হচ্ছে ‘কেয়া’ মানে একজন স্বপ্নভারাক্রান্তা এবং এইমাত্র তাকে হলুদ মাখানো বালিকা না ভেবে ‘কেয়াফুল’ ভাবলে আরো বেশি স্বপ্নময় ও টসটসে লাগে, সে ভেবে দেখে, যদিও এ স্বীকারোক্তি জীবে-জড়ে কিংবা প্রাণীতে-উদ্ভিদে কোনো সংঘাতকে বড়ো বা ছোট করে তোলে না বস্তুত, শেষে চতুর্ভুজের এ কোণেই সে সিদ্ধান্ত নেয়, শব্দের এসব বিবিধার্থ সংগ্রহের মানে-টানে নিয়ে বন্ধুদের সাথে পত্রালাপে যেতে হবে, কেননা তার চোখ মাঝে-সাঝেই বাইরে না দেখে ভেতর দেখায় অতিমাত্রায় নিবিষ্ট হয়ে যায়, এ তার যুগ-জনমের অভ্যেস, এ থেকেও তার একজীবনে রেহাই নেই, এখনো তাই হচ্ছিল, কেননা সে ততক্ষণে বহিরাচ্ছন্নতা থেকে অন্তরোন্মাদনার খোঁচায় জেগে উঠেছে, আর অমনি বলা নেই কওয়া নেই প্যাডের বাঁদিকের একটা রোলপথে সবুজ রঙের জিপগাড়ি ঢুকে পড়ে হাম্বি-তাম্বি করে, এর নিচে চাপা পড়ে মরতে-মরতে যখন জীবনের একটি সুতো ধরে সে ঝুলে পড়তে পারে, ঠিক তখনই চোখ গিয়ে পড়ে সামনের খাদে, তাতে মনে হয় গাড়ির ভীতির চেয়ে এই ভীতি আরো বেশি প্রবল, কেননা ফুটপাতে যদি ম্যানহোল খোলা থাকে, তবে এটা নিশ্চিত যে তা মানুষ মারবার জন্যেই, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের এ নতুন কর্মসূচিটি কবে থেকে যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় হাতে নিয়েছে এবং নগর কর্তৃপক্ষকে কবে-কবে-যে তার বাস্তবায়নের দায়িত্বটাও অর্পণ করে রেখেছে, তা তার জানশোনার আওতার মধ্যেই নেই, তবে এ মুহূর্তে সে এটাই দেখতে পাচ্ছে যে, ঢাকনাহীন ম্যানহোলগুলো একটা করে আস্ত মানুষ গিলে ফেলবার জন্যে রীতিমতো ওঁৎ পেতে আছে, আর গাড়িটা মারতে লেগেছিল নিছক দুর্ঘটনাবশত, এটা এজন্যে বলা যে, ফুটপাত মানে পায়ে চলার পথ এবং শহরের পায়ের পথে মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী খুব একটা হাঁটে না বস্তুত, মাঝে-মধ্যে এক দু’টা খেপা কুকুর এ-বাড়ি ছেড়ে ও-বাড়ি, এবং নানা রঙের শখের বিড়ালকে দেখা যায় দিনে-রাতে দু'বেলায়ই, এবং ইঁদুর যায় তার মতো করে থেমে থেমে, নাক ঘষে ঘষে, কখনো বা নিচের স্যুয়ারেজ পথ দিয়ে, উলটো পায়ে, অ্যাডভেঞ্চার বিষয়ক আলাপ, যেটা দীর্ঘপথ রিক্সা খুঁজে-খুঁজে হাঁটার সময় এক অফিসবন্ধুর সাথে প্রথমবার মৃত্যুর তিনঘণ্টা ও পাস্তুরিত দুধের দু’ঘণ্টা পর হয়েছিল যে, বর্ষাকালে যখন রাজপথ-সাঁতরানো ঢল ও মানবকুলের গৃহে ব্যবহৃত পানি গিয়ে পড়ে পাইপে, তখন ইঁদুরের নিশ্চিত মৃত্যুর আশঙ্কাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না, একথা ইঁদুরটা দেখামাত্র তার মনে পড়ে, আর অমনি অভিমান খুবলে ওঠে নগরপালের প্রতি, যে এমন করে খুলে রেখেছে ম্যানহোলের হিংস্র হা হয়ে থাকা মুখ, তার বাপের কবর

সে এখন কী একটা ধোঁয়ার মতো নিরাবয়ব শক্তির দ্বারা তাড়িত বলে, সযত্নে রক্ষিত জরুরি সঞ্চয়টুকুকেও মন খুলে ছুড়ে দেয় দূরে, এবং আবারো বাঁয়ে চেয়ে পা সোপর্দ করে পঞ্চভুজে, যেটা বাড়ি নং-৩, রোড নং-৩, ব্লক নং-এ, সেকশন নং-৬, ঠিক তার সামনে গিয়ে মনে হয়, একটু এগোলেই চেনা পথ, আর অমনি মনটা খারাপ হয়ে যায়, তবু গা না করে হেঁটে-হেঁটে বহুগামী বিদীর্ণ ষড়ভুজে পড়ে এবং পায়ে শিকল অনুভব করে সে, তার মনে হতে থাকে এরচে’ বরং থেমে থাকা ভালো, যেই ভাবা সেই কাজ, পা জাপটে ধরল জড়তা নামক মন্দীভবন ক্রিয়া, ফুটপাত থেকে ডানে ধনুকের মতো বেঁকে গেল শরীর, অল্পক্ষণ পর ফের গতিপ্রাপ্ত হলে ঘাসায়িত জায়গাটা দিয়ে সে পা ডুবিয়ে হেঁটে যেতে-যেতে রাহস্যিক দৃষ্টিতে ওকে নিরীক্ষণ করে, তার পশ্চাৎ থেকে অগ্রে গমন করে একটি ছেলে, কোথাও না-থেমে ছেলেটির পশ্চাতে সে সোজা পেরিয়ে যায় দ্বিখণ্ডিত মহাসড়ক, পিচ ও ঘাসের সঙ্গমস্থলে দাঁড়িয়ে সে ভাবতে থাকে কিছু একটা, ততক্ষণে বিভিন্ন চরিত্রের প্রাণীদের ততধিক বিচিত্র বাহন তার বাঁদিক দিয়ে ছুটে যায়, এমনকি একটি শূন্য রিক্সাও যায় যাত্রী প্রত্যাশায়, তখন তার মনে হয় রিক্সায় চড়লে ভালো হয়, কিন্তু চোখ থেমে আছে অন্যপারে, একেবারে সোজা ঢুকে যাওয়া পথটিতে, ঝট করেই পিচের উপর দিয়ে তরতর করে মাঝখানে চলে যায় ডানদিকে চেয়ে এবং একটুও না-থেমে বাঁদিকে ওপারের অংশে, তথা সপ্তভুজের দূরত্বে, কিন্তু ভাবনা হেরে যায় এবং হেরে যায় পা-ও তাৎক্ষণিকতার কাছে, কেননা একটু পরে দেখা গেল, পড়শির অন্দরে না-ঢুকে, ভুজ ভেঙে সে ওপারের ফুটপাত ধরে অষ্টভুজে সমর্পণ করল নিজেকে, এদিকে বারবার আসা হয়, অথচ এটুকু ফুটপাত তার কখনো মাড়ানো হয় নি, কিন্তু যাত্রা করেই সে দেখল, সামনের নিচেটায়, ঘাসের উপরে ফেলে রাখা ভাঙা গাড়ির বডিতে, আরো দু'টো বালকসহ তাকে অতিক্রম করে আসা কালো-গেঞ্জি-পরা বালকটি বসে তার দিকে সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, এবং ওদের কাছাকাছি চলে যেতেই, কালো-গেঞ্জি তার সামনে-সামনে হাঁটতে লাগল, ডানে তখন ডেন্টাল ক্লিনিক, যার বাউন্ডারি জুড়ে বড়ো বড়ো দু'টো মাঢ়ি আঁকা, যে দু'টোর একটিরও বত্রিশটি দাঁত নেই, খুব বেশি হলে পনেরটি হবে তার মনে হলো, এই ছেলেটিকে এক থাপ্পড় দিয়ে, যদি এরকম পনেরটি রেখে বাকি দাঁতগুলো ফেলে দেয়া যায়, তবে সঠিক তথ্যটি হয়ত পাওয়া যাবে যে, ওর এর আগেও কখনো কোনো দাঁতের ডাক্তারের প্রয়োজন হয়েছিল কি না, কিন্তু এ পরীক্ষা অপ্রয়োজনীয় ঠেকে তার কাছে, যখন ওই ছেলের অজস্র প্রতিমূর্তি বিভিন্ন দিক থেকে তার দৃষ্টিসমক্ষে আবির্ভূত হতে থাকল, এটা ভয়ের কারণ নয় তার মনে হলো, কেননা সে নির্ভেজাল পথিক, অপরাধে জড়িত না-থাকলে ভয়তাড়িত হওয়া বোকামি, এরকম বোকামি সে অনেক করেছে জীবনে, কিন্তু আর নয়, ভেবেই ঝট্ করে বুকটাকে ইঞ্চিখানেক উঁচু বানিয়ে তুলল সে এবং একটি বুলডোজারের গা ঘেঁষে, বালু সাঁতরিয়ে অষ্টভুজটা অতিক্রম করতে থাকল, আর তখনি ডানপাশের একটা সাইনবোর্ডের সাথে তার দৃষ্টির হলো মুখোমুখি সংঘর্ষ, এ আকস্মিকতায় কতজন হতাহত ভেতরে, সে হিসেবটা করা খুব জরুরি ঠেকতেই মনে হলো, রুমে ফেরাটাই অপেক্ষাকৃত বেশি জরুরি, কেননা পথে হাঁটতে-হাঁটতে এত বড়ো অঙ্ক কষা যায় না, যেহেতু মানুষ কম্পিউটার আবিষ্কার করলেও সে নিজে মোটেই কম্পিউটার নয়, অবশ্য এটা অস্বীকার করার কোনো জো নেই যে, সাইনবোর্ডটির মর্মার্থের ভেতরে মুখ-লুকিয়ে-রাখা-জন তার দীর্ঘ সময়ের বন্ধু ছিল, এমনকি চিঠিপত্রে তা এখনো সত্য বটে, তবে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এই ত্রিকাল জুড়েই এটা সত্য যে, ও তার সবচে’ বড় মানুষ-শত্রু, কাজেই হাজার রকম মানবীয় ভীতিবোধের মধ্য থেকে চলনক্ষম কয়েকটি ভীতিবোধ তার শরীরে সঞ্চারিত হলো, কেননা কেউ এমন জাতসাপ সঙ্গে নিয়ে শোয়-না বস্তুত, শত্রু পড়শি হলে তার সাথে একজাতের সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে বটে, এজন্যেই হবে, একটু থেমে মুখে আঙুল পুরে সে-তার নিজের দাঁতগুলো গণনা করতে লাগে, এবং মাত্র বাইশটি পেয়ে, রাগে এমন অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে যে, সে সিদ্ধান্ত নেয় মুখে কিংবা চিঠিতে তার প্রতিবেশ সম্পর্কে, ওকে অথবা ওর প্রতিমূর্তিকে কখনো জানাতে হবে এহেন ক্ষরণের কথা, পা তখন জড়তা ভাঙে এবং অষ্টভুজের শেষ মাথায় পাকুড় গাছের নিচে, সিগারেট কিংবা কলা কিংবা কনডম কিংবা অন্যকিছু কিনতে দাঁড়ায় এবং পানের ভেতরে চুন বেশি দেয়ার জন্যে দোকানদারকে কষে একটা গাল ঝাড়ে, ব্যাটা থতমত খেয়ে আরেকটি পান হাতে ধরিয়ে দিতেই সে নবম ভুজে নামে, অবশ্য এটিকে নবম ভুজ না বলে প্রথম ভুজের পশ্চাৎপ্রসারণ বলা অধিক যৌক্তিক, কেননা যে বিন্দু থেকে সে যাত্রা শুরু করেছিল এবং এখন সে যে অবস্থানে আছে, তা একই রেখায় অবস্থিত

মাসুদের পালা শেষে যখন জামালের পালা শুরু, তখন তার ছাদে যেতে ইচ্ছে হলে ওপরে তদন্ত পাঠায় এটা দেখতে যে, ছাদের দরজাটি খোলা কি না, কিন্তু দোতলায় যেতেই কেউ একজন তথ্যদূতকে ফিরিয়ে দেয় এই বলে যে, সে যেন জানায় তা বন্ধ, কিন্তু নিচে দাঁড়িয়ে ওই কথোপকথন শুনে, বিবিধানুষঙ্গের সহযোগিতায় সে বুঝতে পারে যে, প্রকৃতপক্ষে দরজাটি খোলা, ইচ্ছে করলেই সে সেখানে যেতে পারে, তবে একজন মানুষ তার অধীনস্তকে মিথ্যা বলার জন্যে কেন নির্দেশ দেয় এবং অধীনস্তই বা কেন এসে উলটো সত্যটাই বলে, এটা না বোঝে সে কিছুতেই পা বাড়াতে পারে না ওপরের দিকে, ততক্ষণে শুরু হয়ে যায় মানসাঙ্কের বিভিন্ন আঙ্গিক পাঠ, দরকষাকষি এবং একপর্যায়ে জটিল ক্যালকুলাস, এরকম গণিতাচ্ছন্নতায় রাত যখন শেষপাদে, যখন পুনর্বার নিজের পালায় যোগ দেবার জন্যে মাসুদ প্রাতঃকর্ম সারছে, তখন মিলে যায় সব জটিল অঙ্কের ফল, আর এ ফলের সাঙ্কেতিক রেখাকে অনুবাদ করে যা পাওয়া যায়, তা হলো এই যে, কেবল তার শত্রুর নয়, নিজের আস্তানাসহ, গোটা অষ্টভুজ ক্ষেত্রটাকেই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটা বোমার আঘাতে তুলোপেঁজা করে দিগ্বিদিকে উড়িয়ে দিতে হবে

ভালো-লাগা মন্দ-লাগার অনুভূতিটা চক্রক্রমিক

অচেনাকে উন্মোচনের আকৈশোর বাসনা তার, অরণ্যের, খতিয়ে দেখতে চায় ভেতরে কী আছে আড়ালে-আবডালে, কোন্ অন্ধকারে লুকানো কোন্ সুর, ছবির মহিমা, কাব্যবীজ, অচেনার উরু-জঙ্ঘা-স্তন কেমন ধাতুয় নির্মিত, কতটা সুসহ-- তার এ আচ্ছন্নতার কথা অনেকেই জানে, অথচ এ চেনা জগৎ-প্রতিবেশ থেকে সটকে পড়বার চমৎকার এক সুযোগকে হাতের কাছে পেয়েও তার এরকমভাবে নেতিয়ে যাবার কারণ আবিষ্কার করতে না পেরে, রাহা নিজেই একটু রহস্যময় ও অচেনার ব্যঞ্জনা ধারণ করে সামনে এসে দাঁড়ায়, সে ভাবে অন্যকথা, নিজের বাগানে চেয়ে, এই যে আমি, রাহা, আলোর খাপে যে আটকাই না, সতত প্রবহমাণ ও ঔজ্জ্বল্যসঞ্চারী, তার মোহে জগতের সমস্ত প্রজাপতি একদিন ওড়া ভুলে কাঁধের ভূগোলে এসে যদি বসে যায়, তো বিস্ময় মানবে কে

রাহা ওকে জানে, অরণ্যকে, কালো-কালো বনতিলক ওর শরীরের সৌরভ বাড়াতে যেমন মগ্নতাচারী, সে ওর মনোরঞ্জনে নিজেকে খুলে রাখে তেমনি নিষ্ঠ-নিবিড়তায়, জানে বিকশিত সবুজকে সংরক্ষণ করতে হয় বলেই নয়, বরং তারও অধিক পরিযায়ী পাখিদের জননবেদনা বিষয়ক কিছু চিন্তাজালে অরণ্যকে জড়িয়ে থাকতে হয় রাতদিন, ষড়ঋতু ব্যাপে, তার কোনো অবসর নেই, একটা মুহূর্তে হয় বনঘুঘু ডাকছে না ঠিক কিন্তু পাতা ঝরছে অথবা অন্যকিছু, বাতাস বইছে, রোদ উঠছে, অতএব একটা-না-একটা ব্যস্ততা তাকে জড়িয়ে থাকেই, এর মধ্যেও তার বেরিয়ে পড়বার শখ পরিচিত পরিসর ছেড়ে, সে কেবল এজন্যে যে অচেনাকে চেনা হবে, তার ডাকনাম, প্রিয়-অপ্রিয় জানা যাবে, রূপ-বৈভব দেখা হবে, কিন্তু এত যার আকাঙ্ক্ষা, ক্ষুধানিবৃত্তির সমস্ত উপায়-উপকরণ কোনোভাবে যদি ধর্তব্যের মধ্যে এসেই যায় তার, তবে কেনই-বা একজনের বিপরীতাগ্রহ হবে, এতবড়ো রহস্যের সম্মুখে রাহার আর পড়তে হয় নি জীবৎকালে, সে জেনেছে একটা শিশু যদি খেলতে চায় তাকে কোলের বন্ধন থেকে মুক্তি দিলেই সে খুশি হয়, বন্দি পাখির যখন উড়বার সাধ হয়, তখন খাঁচার দ্বার খুলে দিলেই সেটা প্রসন্ন হয়, কিন্তু এখানে, অরণ্যের বেলায়, এত কী ব্যতিক্রম ঘটেছে যে, তার সারাজীবনের বেরিয়ে পড়বার ইচ্ছা ও চেষ্টাকে সম্মান দেখিয়ে, অচেনা উৎস থেকে আসা আহ্বানে সাড়া না-দিয়ে বরং বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখাচ্ছে, নীরবে মুখভার করে আছে মেঘমহল্লার থেকে বৃষ্টিদের আমন্ত্রণ করে এনে, কী এমন ঘনীভূত রহস্য অরণ্যের মাঝে রয়েছে যে, সে এ ভেজা অন্ধকারেও বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে

রাহা তার খেয়াল থেকে সাড়া লাভ করে, আস্তে-সুস্থে পরিকল্পনাটা বাগিয়ে নেয়, তারপর অরণ্যের সামনে একটা পছন্দমতো অবস্থানে দাঁড়িয়ে স্লো-মোশানে নিজেকে ক্রমশ বিবস্ত্র করে দিতে থাকে, সে দ্রৌপদী নয় যদিও, কারণ তার বস্ত্র অন্য কেউ নয়, হরণ করছে সে নিজেই, কোনোরূপ শব্দসমারোহ নেই, ঠোঁটে-মুখে কোনোই বিকার নেই, চোখ দু’টো গভীর কিছু পর্যবেক্ষণে রত, এ অর্থে যে, সে ইতোমধ্যে যে পরিকল্পনাটা এঁটেছে এবং পরিকল্পনামাফিক যে কর্মটা সে সারছে, তাতে প্রত্যাশিত ফলাফলটা আয়ত্তে আসছে কি না, অথবা এই ঘটনায় অরণ্য কীভাবে সাড়া দিচ্ছে

অরণ্য স্থির নিশ্চিত যে তার সামনেটা অন্ধকার, অঙ্কের হিসেব, কাজেই নড়চড় হবার কথা নয়, কাব্যের কল্পনাবিলাসিতা গণিত কোনোদিন টলারেট করে না, গণিতবিদেরা নিজেরা ভেতরে-ভেতরে কল্পনাবিলাসী ছিলেন এরকম হতে পারে, কিন্তু সূত্র আবিষ্কারে ভেতরকার সে কল্পনাবিলাসিতাকে প্রত্যক্ষভাবে কাজে লাগিয়েছেন এরকম ভাবা যায় না, যেহেতু দুয়ে দুয়ে চার না-লিখে পাঁচ লিখলেও কাব্যের সম্ভ্রমহানী ঘটে না কিন্তু গণিতের ঘটে, তো সামনে যদি নিশ্চিত অন্ধকার, তবে কী এমন দায় তার যে তাকে বেরোতেই হবে, যেখানে বাস তার সেখানটাও আলোময় নয়, কোনোদিন ছিল না এ ডালপাতাদের ভিড়ে, কিন্তু এখানে আর যাই হোক রাহা আছে, তার অন্ধকারের অবলম্বন, তাকে ছেড়ে এই ঘুটঘুটে পথে নেমে কী এমন রত্ন মিলবে, যা তার এরকম বোকামির ঘাটতিটাকে পুষিয়ে দেবে, তার ওপর ব্যাপারটা যেখানে নিশ্চিত যে সামনে অন্ধকার, নিশ্চিতি-অনিশ্চিতি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার ত্রুটি থাকতে পারে না, কেননা গণিতটা সে কমবেশি বোঝে, যতটা বুঝলে তেলটা-নুনটার হিসেবে কোনোদিন আটকাতে হয় না, ততটা গাণিতিক জ্ঞানই এ হিসেবের জন্যে যথেষ্ট, অতএব সে যাবে না, অচেনারা যে পাড়ায় থাকে, সেখানের তালগাছগুলো কেমন লম্বা, স্নানঘাটগুলো কেমন পরিচ্ছন্ন, এসব জানার জন্যে তাকে আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে, অন্তত কদিন স্থির থেকে দেখে নিতে হবে, নিশ্চিত যে অন্ধকারটা ফণা তুলে আছে, তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল কি না

রাহা এখন সম্পূর্ণ দিগম্বর তার শূন্যতম জন্মদিনের মতো, দু'পা ফাঁক করে সে নিঃশব্দে বসে গেল অরণ্যসকাশে, অরণ্য দেখল তার স্তন-যোনি-নিতম্ব সব কুৎসিত, ঘোর অন্ধকার, কালো, ভয়াবহ-- এগুলো এত চেনা ও ব্যবহৃত যে তার ঘেন্না ধরল, বিবশ চোখ দু'টো মুদে গেল এবং সহসাই জ্বলে উঠল আলো, চোখ বন্ধ করলে সামনে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায় সমুদ্র ও পাহাড়ের ঢাল, অরণ্যও দেখল, অচেনারা সবাই পথ আলো করে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, কেউ সেখানে নিবস্ত্রা নয়, রহস্য ঘনীভূত সেসবের শ্রী-অবয়বে, লোভাতুরা হাতছানি যেন, অরণ্য ভেবে ওঠে সুপারসনিক বেগে, এ রহস্যসমুদয় জানতে হবে, রাহাকে হয়েছে জানা, এবার অন্যে যাব ভবিষ্য আলোয়, সামনেই সিদ্ধি, বিড়বিড় করে উঠে দাঁড়ায় সে, চোখ মেলে এবং বাক্সপেটরা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অচেনার পথরেখা ধরে

রাহার এ সাফল্য তাকে তার যোগ্যতা সম্পর্কে আরেকটি নিশ্চিতি দেয়, নিজের প্রতি তার আস্থা বাড়ে, তার দরকার ছিল অরণ্যকে ঘরের বাইরে নেয়া, কেননা সে ভালোবাসে তাকে, এবং সে জানত যে কেবল এভাবেই তাকে রাজি করানো সম্ভব, এ সাফল্যে সে খুব খুশি হয়, সে নিশ্চিত যে, অরণ্য একদিন অচেনাকেও চিনে নেবে, ও তখন তাদেরও অপছন্দ করবে এবং ফিরে আসবে পুরানোয়, তার বুক জুড়ে, যেখানে ততদিনে অগেয় গীতসমেত অজস্র না-চেনা রহস্যপাখি জড়ো হবে দূরে থাকার সুবাদে, তার নিজস্ব অলিগলি ভরে উঠবে চাপ-চাপ সুস্বাদে, না-চেনা রহস্যপাখিদের এই অগেয় গীতসুধা পানতৃষ্ণায়ই অরণ্য সেদিন আবার তার হবে, রাহা জানে