Categorisation Narrows the Glory of Creation. A composition of prose miscellany. প্রকাশক : প্রতীতি। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০০৩।

Thursday, January 31, 2008

বৃত্ত ও বৃত্তাবদ্ধতা বিষয়ক একটি আক্রোশের সরল অনুবাদ

চুন বেশি হয়ে যাওয়া বড়ো পানটি মুখে পুরে ধীরে ধীরে সড়ক পেরিয়ে অ্যাকেশিয়া গাছটার গোড়ায় দাঁড়িয়ে গমনপথের দিকে মুখ রাখলে বাঁহাত যেদিকে থাকে, তাকাবার প্রয়োজনে সে অনুভব করে যে মেপে দেখা দরকার কত দূরত্বে ভাবনা রেখে এল, তারপর অর্ধেক পথ ভাবতে-ভাবতে এগিয়ে, বাড়িটা পর্যন্ত আসতে দু'ভাগে সাত-আটটা তরতাজা যুবক দেখে সে, তখন গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল মাসুদ, এইমাত্র ওর পালা শুরু হয়েছে, জামাল উদ্দিন, যে আগের পালার, ওর ডিউটিকালেই বাইরে বেরোয় সে, ডানদিকের পুরানো বাড়ি দু'টোর সামনে দিয়ে, যেখানের ঠিক উলটোয় পুরানো রহস্য লুকানো, তার অন্তে আধমতো অন্ধকারে দু'টো বয়েসী যুবক ড্রেনের পুলে পা ঝুলিয়ে বসা ছিল, সোজা মুখে, খুব স্বচ্ছন্দে বাঁদিকে হাঁটা ধরল সে আলো-সন্ধানে, পথে সজনে গাছের অন্ধকারে দু'টো বালিকার গা ঘেঁষা খায় সে, পাশে সবাই টিভিতে মগ্ন প্যাকেজ নাটকে, জানালার পর্দা কাঁপিয়ে বাজে সব চিৎকার এসে কানে বিঁধছিল তার, শেষে ড্রেনটি ডিঙানোর পরেও পাঁচটি কিশোরীকে ডিঙাতে হয়, তখন কালো ঘনপিচ-রহস্য ঘেঁষা অন্ধকারের ঝাঁঝমাখা আলো ভ্রূ-ঝাপসা চোখেও বেশ আন্দাজ করা যাচ্ছিল, ডানপাশে রোল করা প্যাডের মতো অজস্র রাস্তার একটির কোনায় আট-নটি বখে যাওয়া পোলা ঢেঙা করছে, অথচ তার আগেই সে রহস্যে সেঁধেছে, কিশোরীদের পরেই, সজনে গাছের গোড়া থেকেই যার প্রস্তুতি শুরু, এবার ঠিক রাস্তার বিপরীতে, প্যাডের বিপরীতে, সে খুব করে কুতিয়ে কুতিয়ে মুতে নেয়, হাত দুই উঁচু নির্মাণাধীন বিল্ডিং-এর পাশের অন্ধকারে, যেখানের ঠিক পিছেই বখাটে যুবারা, তার মনে হলো, ফাঁদ পেতে আছে লোকটা, হিসুকালে যে ডানপাশের নির্মাণাধীন ভবনের দু'হাতে বসা ছিল শাদা-জামা-পরা, শাদাকে কেননা অন্ধকারেও চেনা যায় ঠিকঠাক, সে সবটা ডুবছিল ততক্ষণে, এদিকে ইনডোরের আলো ফুরিয়ে যায়, ওদিকে ময়লা অন্ধকার, ডুবতে হবে তার ভেতরেই, এবং সঙ্কোচও লাগছিল কিছু ছেলেটাকে, বস্তির ওপাশ থেকেই যে হাঁটতে লেগেছে, তাঁকে ডিঙিয়ে যেতে মনে হয় যে, রহস্যের গন্ধটা সে টের পেয়ে যাবে, তবু পেরোল সে, বাতাসে খোলামেলা শুয়ে থাকা মহিলা ও শিশুদের একটিকে প্রায় মাড়িয়ে

আজ কোনো কাজ ছিল না শুধু আলসেমি ছাড়া, যদি-বা আলসেমিকে কোনো কাজ ভাবা যায়, অবশ্য বেরোবার আগে সে একপ্রস্থ চাষ সেরেছে নাছোড় দিনপঞ্জির পাতায়, কেননা এর হাত থেকে তার কোনো রক্ষা নেই ইহকালে, যা সে ইতোমধ্যেই খুব করে বুঝে গেছে, যাহোক, ভ্রমণের ত্রিভুজে পা দেবার কিছু পরেই সে বাহ্য রহস্যে সেঁধিয়ে ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় ডানপাশের পথে, মন টানে যেদিকে রঙিনবাতির দপদপ, তার ঠিক আগেই বোধ হচ্ছিল যে সে ভুল করেছে, ঠিক তৃতীয় ভুজের পেছনে বর্ধিত রেখা বরাবর না গিয়ে, যেদিকে কাঁচাবাজার দাঁড়িয়ে সবজির তাজাঘ্রাণ গায়ে মেখে, ওদিকে না-হাঁটা পথ, অচেনা-গুরুত্ব আছে, তাই তার মেজাজ স্থাপিত ডানে, কেননা পেছনে ফেরা তাকে দিয়ে হবে না, ওইসব ভণ্ডামি করে কোনো লাভ নেই, বরং এই ভালো, সামনে যা কিছু, সামনের ডানদিকে লাল-লাল নীল-নীল পাঁচতলা, হলুদ গ্রাউন্ডে ঝকমকিয়ে উঠছে এবং রঙের রূপকথা ঝুলিয়ে রেখেছে গোটা দেহে, ভারি সুন্দর করে রাহস্যিক আঁচড়ের মাঝখানে ‘কেয়ার হলুদবরণ’ শীর্ষক ত্রিভুজটি সাঁটিয়ে দিয়েছে কাপড়ের গেটে, নিচে, কিছুটা ভেতরে মুখরা দু'টো শাদা গাড়িকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে এখানে, কেননা ‘হলুদবরণ’ মানে দু'টো বিপরীতধর্মী যৌনাঙ্গধারীর মধ্যে একজীবন ধরে সাধনযোগ্য একখানি বয়স্ক দলিলের মহড়া, কিন্তু এই যে এতক্ষণে মনে হচ্ছে ‘কেয়া’ মানে একজন স্বপ্নভারাক্রান্তা এবং এইমাত্র তাকে হলুদ মাখানো বালিকা না ভেবে ‘কেয়াফুল’ ভাবলে আরো বেশি স্বপ্নময় ও টসটসে লাগে, সে ভেবে দেখে, যদিও এ স্বীকারোক্তি জীবে-জড়ে কিংবা প্রাণীতে-উদ্ভিদে কোনো সংঘাতকে বড়ো বা ছোট করে তোলে না বস্তুত, শেষে চতুর্ভুজের এ কোণেই সে সিদ্ধান্ত নেয়, শব্দের এসব বিবিধার্থ সংগ্রহের মানে-টানে নিয়ে বন্ধুদের সাথে পত্রালাপে যেতে হবে, কেননা তার চোখ মাঝে-সাঝেই বাইরে না দেখে ভেতর দেখায় অতিমাত্রায় নিবিষ্ট হয়ে যায়, এ তার যুগ-জনমের অভ্যেস, এ থেকেও তার একজীবনে রেহাই নেই, এখনো তাই হচ্ছিল, কেননা সে ততক্ষণে বহিরাচ্ছন্নতা থেকে অন্তরোন্মাদনার খোঁচায় জেগে উঠেছে, আর অমনি বলা নেই কওয়া নেই প্যাডের বাঁদিকের একটা রোলপথে সবুজ রঙের জিপগাড়ি ঢুকে পড়ে হাম্বি-তাম্বি করে, এর নিচে চাপা পড়ে মরতে-মরতে যখন জীবনের একটি সুতো ধরে সে ঝুলে পড়তে পারে, ঠিক তখনই চোখ গিয়ে পড়ে সামনের খাদে, তাতে মনে হয় গাড়ির ভীতির চেয়ে এই ভীতি আরো বেশি প্রবল, কেননা ফুটপাতে যদি ম্যানহোল খোলা থাকে, তবে এটা নিশ্চিত যে তা মানুষ মারবার জন্যেই, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের এ নতুন কর্মসূচিটি কবে থেকে যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় হাতে নিয়েছে এবং নগর কর্তৃপক্ষকে কবে-কবে-যে তার বাস্তবায়নের দায়িত্বটাও অর্পণ করে রেখেছে, তা তার জানশোনার আওতার মধ্যেই নেই, তবে এ মুহূর্তে সে এটাই দেখতে পাচ্ছে যে, ঢাকনাহীন ম্যানহোলগুলো একটা করে আস্ত মানুষ গিলে ফেলবার জন্যে রীতিমতো ওঁৎ পেতে আছে, আর গাড়িটা মারতে লেগেছিল নিছক দুর্ঘটনাবশত, এটা এজন্যে বলা যে, ফুটপাত মানে পায়ে চলার পথ এবং শহরের পায়ের পথে মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী খুব একটা হাঁটে না বস্তুত, মাঝে-মধ্যে এক দু’টা খেপা কুকুর এ-বাড়ি ছেড়ে ও-বাড়ি, এবং নানা রঙের শখের বিড়ালকে দেখা যায় দিনে-রাতে দু'বেলায়ই, এবং ইঁদুর যায় তার মতো করে থেমে থেমে, নাক ঘষে ঘষে, কখনো বা নিচের স্যুয়ারেজ পথ দিয়ে, উলটো পায়ে, অ্যাডভেঞ্চার বিষয়ক আলাপ, যেটা দীর্ঘপথ রিক্সা খুঁজে-খুঁজে হাঁটার সময় এক অফিসবন্ধুর সাথে প্রথমবার মৃত্যুর তিনঘণ্টা ও পাস্তুরিত দুধের দু’ঘণ্টা পর হয়েছিল যে, বর্ষাকালে যখন রাজপথ-সাঁতরানো ঢল ও মানবকুলের গৃহে ব্যবহৃত পানি গিয়ে পড়ে পাইপে, তখন ইঁদুরের নিশ্চিত মৃত্যুর আশঙ্কাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না, একথা ইঁদুরটা দেখামাত্র তার মনে পড়ে, আর অমনি অভিমান খুবলে ওঠে নগরপালের প্রতি, যে এমন করে খুলে রেখেছে ম্যানহোলের হিংস্র হা হয়ে থাকা মুখ, তার বাপের কবর

সে এখন কী একটা ধোঁয়ার মতো নিরাবয়ব শক্তির দ্বারা তাড়িত বলে, সযত্নে রক্ষিত জরুরি সঞ্চয়টুকুকেও মন খুলে ছুড়ে দেয় দূরে, এবং আবারো বাঁয়ে চেয়ে পা সোপর্দ করে পঞ্চভুজে, যেটা বাড়ি নং-৩, রোড নং-৩, ব্লক নং-এ, সেকশন নং-৬, ঠিক তার সামনে গিয়ে মনে হয়, একটু এগোলেই চেনা পথ, আর অমনি মনটা খারাপ হয়ে যায়, তবু গা না করে হেঁটে-হেঁটে বহুগামী বিদীর্ণ ষড়ভুজে পড়ে এবং পায়ে শিকল অনুভব করে সে, তার মনে হতে থাকে এরচে’ বরং থেমে থাকা ভালো, যেই ভাবা সেই কাজ, পা জাপটে ধরল জড়তা নামক মন্দীভবন ক্রিয়া, ফুটপাত থেকে ডানে ধনুকের মতো বেঁকে গেল শরীর, অল্পক্ষণ পর ফের গতিপ্রাপ্ত হলে ঘাসায়িত জায়গাটা দিয়ে সে পা ডুবিয়ে হেঁটে যেতে-যেতে রাহস্যিক দৃষ্টিতে ওকে নিরীক্ষণ করে, তার পশ্চাৎ থেকে অগ্রে গমন করে একটি ছেলে, কোথাও না-থেমে ছেলেটির পশ্চাতে সে সোজা পেরিয়ে যায় দ্বিখণ্ডিত মহাসড়ক, পিচ ও ঘাসের সঙ্গমস্থলে দাঁড়িয়ে সে ভাবতে থাকে কিছু একটা, ততক্ষণে বিভিন্ন চরিত্রের প্রাণীদের ততধিক বিচিত্র বাহন তার বাঁদিক দিয়ে ছুটে যায়, এমনকি একটি শূন্য রিক্সাও যায় যাত্রী প্রত্যাশায়, তখন তার মনে হয় রিক্সায় চড়লে ভালো হয়, কিন্তু চোখ থেমে আছে অন্যপারে, একেবারে সোজা ঢুকে যাওয়া পথটিতে, ঝট করেই পিচের উপর দিয়ে তরতর করে মাঝখানে চলে যায় ডানদিকে চেয়ে এবং একটুও না-থেমে বাঁদিকে ওপারের অংশে, তথা সপ্তভুজের দূরত্বে, কিন্তু ভাবনা হেরে যায় এবং হেরে যায় পা-ও তাৎক্ষণিকতার কাছে, কেননা একটু পরে দেখা গেল, পড়শির অন্দরে না-ঢুকে, ভুজ ভেঙে সে ওপারের ফুটপাত ধরে অষ্টভুজে সমর্পণ করল নিজেকে, এদিকে বারবার আসা হয়, অথচ এটুকু ফুটপাত তার কখনো মাড়ানো হয় নি, কিন্তু যাত্রা করেই সে দেখল, সামনের নিচেটায়, ঘাসের উপরে ফেলে রাখা ভাঙা গাড়ির বডিতে, আরো দু'টো বালকসহ তাকে অতিক্রম করে আসা কালো-গেঞ্জি-পরা বালকটি বসে তার দিকে সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, এবং ওদের কাছাকাছি চলে যেতেই, কালো-গেঞ্জি তার সামনে-সামনে হাঁটতে লাগল, ডানে তখন ডেন্টাল ক্লিনিক, যার বাউন্ডারি জুড়ে বড়ো বড়ো দু'টো মাঢ়ি আঁকা, যে দু'টোর একটিরও বত্রিশটি দাঁত নেই, খুব বেশি হলে পনেরটি হবে তার মনে হলো, এই ছেলেটিকে এক থাপ্পড় দিয়ে, যদি এরকম পনেরটি রেখে বাকি দাঁতগুলো ফেলে দেয়া যায়, তবে সঠিক তথ্যটি হয়ত পাওয়া যাবে যে, ওর এর আগেও কখনো কোনো দাঁতের ডাক্তারের প্রয়োজন হয়েছিল কি না, কিন্তু এ পরীক্ষা অপ্রয়োজনীয় ঠেকে তার কাছে, যখন ওই ছেলের অজস্র প্রতিমূর্তি বিভিন্ন দিক থেকে তার দৃষ্টিসমক্ষে আবির্ভূত হতে থাকল, এটা ভয়ের কারণ নয় তার মনে হলো, কেননা সে নির্ভেজাল পথিক, অপরাধে জড়িত না-থাকলে ভয়তাড়িত হওয়া বোকামি, এরকম বোকামি সে অনেক করেছে জীবনে, কিন্তু আর নয়, ভেবেই ঝট্ করে বুকটাকে ইঞ্চিখানেক উঁচু বানিয়ে তুলল সে এবং একটি বুলডোজারের গা ঘেঁষে, বালু সাঁতরিয়ে অষ্টভুজটা অতিক্রম করতে থাকল, আর তখনি ডানপাশের একটা সাইনবোর্ডের সাথে তার দৃষ্টির হলো মুখোমুখি সংঘর্ষ, এ আকস্মিকতায় কতজন হতাহত ভেতরে, সে হিসেবটা করা খুব জরুরি ঠেকতেই মনে হলো, রুমে ফেরাটাই অপেক্ষাকৃত বেশি জরুরি, কেননা পথে হাঁটতে-হাঁটতে এত বড়ো অঙ্ক কষা যায় না, যেহেতু মানুষ কম্পিউটার আবিষ্কার করলেও সে নিজে মোটেই কম্পিউটার নয়, অবশ্য এটা অস্বীকার করার কোনো জো নেই যে, সাইনবোর্ডটির মর্মার্থের ভেতরে মুখ-লুকিয়ে-রাখা-জন তার দীর্ঘ সময়ের বন্ধু ছিল, এমনকি চিঠিপত্রে তা এখনো সত্য বটে, তবে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এই ত্রিকাল জুড়েই এটা সত্য যে, ও তার সবচে’ বড় মানুষ-শত্রু, কাজেই হাজার রকম মানবীয় ভীতিবোধের মধ্য থেকে চলনক্ষম কয়েকটি ভীতিবোধ তার শরীরে সঞ্চারিত হলো, কেননা কেউ এমন জাতসাপ সঙ্গে নিয়ে শোয়-না বস্তুত, শত্রু পড়শি হলে তার সাথে একজাতের সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে বটে, এজন্যেই হবে, একটু থেমে মুখে আঙুল পুরে সে-তার নিজের দাঁতগুলো গণনা করতে লাগে, এবং মাত্র বাইশটি পেয়ে, রাগে এমন অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে যে, সে সিদ্ধান্ত নেয় মুখে কিংবা চিঠিতে তার প্রতিবেশ সম্পর্কে, ওকে অথবা ওর প্রতিমূর্তিকে কখনো জানাতে হবে এহেন ক্ষরণের কথা, পা তখন জড়তা ভাঙে এবং অষ্টভুজের শেষ মাথায় পাকুড় গাছের নিচে, সিগারেট কিংবা কলা কিংবা কনডম কিংবা অন্যকিছু কিনতে দাঁড়ায় এবং পানের ভেতরে চুন বেশি দেয়ার জন্যে দোকানদারকে কষে একটা গাল ঝাড়ে, ব্যাটা থতমত খেয়ে আরেকটি পান হাতে ধরিয়ে দিতেই সে নবম ভুজে নামে, অবশ্য এটিকে নবম ভুজ না বলে প্রথম ভুজের পশ্চাৎপ্রসারণ বলা অধিক যৌক্তিক, কেননা যে বিন্দু থেকে সে যাত্রা শুরু করেছিল এবং এখন সে যে অবস্থানে আছে, তা একই রেখায় অবস্থিত

মাসুদের পালা শেষে যখন জামালের পালা শুরু, তখন তার ছাদে যেতে ইচ্ছে হলে ওপরে তদন্ত পাঠায় এটা দেখতে যে, ছাদের দরজাটি খোলা কি না, কিন্তু দোতলায় যেতেই কেউ একজন তথ্যদূতকে ফিরিয়ে দেয় এই বলে যে, সে যেন জানায় তা বন্ধ, কিন্তু নিচে দাঁড়িয়ে ওই কথোপকথন শুনে, বিবিধানুষঙ্গের সহযোগিতায় সে বুঝতে পারে যে, প্রকৃতপক্ষে দরজাটি খোলা, ইচ্ছে করলেই সে সেখানে যেতে পারে, তবে একজন মানুষ তার অধীনস্তকে মিথ্যা বলার জন্যে কেন নির্দেশ দেয় এবং অধীনস্তই বা কেন এসে উলটো সত্যটাই বলে, এটা না বোঝে সে কিছুতেই পা বাড়াতে পারে না ওপরের দিকে, ততক্ষণে শুরু হয়ে যায় মানসাঙ্কের বিভিন্ন আঙ্গিক পাঠ, দরকষাকষি এবং একপর্যায়ে জটিল ক্যালকুলাস, এরকম গণিতাচ্ছন্নতায় রাত যখন শেষপাদে, যখন পুনর্বার নিজের পালায় যোগ দেবার জন্যে মাসুদ প্রাতঃকর্ম সারছে, তখন মিলে যায় সব জটিল অঙ্কের ফল, আর এ ফলের সাঙ্কেতিক রেখাকে অনুবাদ করে যা পাওয়া যায়, তা হলো এই যে, কেবল তার শত্রুর নয়, নিজের আস্তানাসহ, গোটা অষ্টভুজ ক্ষেত্রটাকেই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটা বোমার আঘাতে তুলোপেঁজা করে দিগ্বিদিকে উড়িয়ে দিতে হবে

ভালো-লাগা মন্দ-লাগার অনুভূতিটা চক্রক্রমিক

অচেনাকে উন্মোচনের আকৈশোর বাসনা তার, অরণ্যের, খতিয়ে দেখতে চায় ভেতরে কী আছে আড়ালে-আবডালে, কোন্ অন্ধকারে লুকানো কোন্ সুর, ছবির মহিমা, কাব্যবীজ, অচেনার উরু-জঙ্ঘা-স্তন কেমন ধাতুয় নির্মিত, কতটা সুসহ-- তার এ আচ্ছন্নতার কথা অনেকেই জানে, অথচ এ চেনা জগৎ-প্রতিবেশ থেকে সটকে পড়বার চমৎকার এক সুযোগকে হাতের কাছে পেয়েও তার এরকমভাবে নেতিয়ে যাবার কারণ আবিষ্কার করতে না পেরে, রাহা নিজেই একটু রহস্যময় ও অচেনার ব্যঞ্জনা ধারণ করে সামনে এসে দাঁড়ায়, সে ভাবে অন্যকথা, নিজের বাগানে চেয়ে, এই যে আমি, রাহা, আলোর খাপে যে আটকাই না, সতত প্রবহমাণ ও ঔজ্জ্বল্যসঞ্চারী, তার মোহে জগতের সমস্ত প্রজাপতি একদিন ওড়া ভুলে কাঁধের ভূগোলে এসে যদি বসে যায়, তো বিস্ময় মানবে কে

রাহা ওকে জানে, অরণ্যকে, কালো-কালো বনতিলক ওর শরীরের সৌরভ বাড়াতে যেমন মগ্নতাচারী, সে ওর মনোরঞ্জনে নিজেকে খুলে রাখে তেমনি নিষ্ঠ-নিবিড়তায়, জানে বিকশিত সবুজকে সংরক্ষণ করতে হয় বলেই নয়, বরং তারও অধিক পরিযায়ী পাখিদের জননবেদনা বিষয়ক কিছু চিন্তাজালে অরণ্যকে জড়িয়ে থাকতে হয় রাতদিন, ষড়ঋতু ব্যাপে, তার কোনো অবসর নেই, একটা মুহূর্তে হয় বনঘুঘু ডাকছে না ঠিক কিন্তু পাতা ঝরছে অথবা অন্যকিছু, বাতাস বইছে, রোদ উঠছে, অতএব একটা-না-একটা ব্যস্ততা তাকে জড়িয়ে থাকেই, এর মধ্যেও তার বেরিয়ে পড়বার শখ পরিচিত পরিসর ছেড়ে, সে কেবল এজন্যে যে অচেনাকে চেনা হবে, তার ডাকনাম, প্রিয়-অপ্রিয় জানা যাবে, রূপ-বৈভব দেখা হবে, কিন্তু এত যার আকাঙ্ক্ষা, ক্ষুধানিবৃত্তির সমস্ত উপায়-উপকরণ কোনোভাবে যদি ধর্তব্যের মধ্যে এসেই যায় তার, তবে কেনই-বা একজনের বিপরীতাগ্রহ হবে, এতবড়ো রহস্যের সম্মুখে রাহার আর পড়তে হয় নি জীবৎকালে, সে জেনেছে একটা শিশু যদি খেলতে চায় তাকে কোলের বন্ধন থেকে মুক্তি দিলেই সে খুশি হয়, বন্দি পাখির যখন উড়বার সাধ হয়, তখন খাঁচার দ্বার খুলে দিলেই সেটা প্রসন্ন হয়, কিন্তু এখানে, অরণ্যের বেলায়, এত কী ব্যতিক্রম ঘটেছে যে, তার সারাজীবনের বেরিয়ে পড়বার ইচ্ছা ও চেষ্টাকে সম্মান দেখিয়ে, অচেনা উৎস থেকে আসা আহ্বানে সাড়া না-দিয়ে বরং বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখাচ্ছে, নীরবে মুখভার করে আছে মেঘমহল্লার থেকে বৃষ্টিদের আমন্ত্রণ করে এনে, কী এমন ঘনীভূত রহস্য অরণ্যের মাঝে রয়েছে যে, সে এ ভেজা অন্ধকারেও বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে

রাহা তার খেয়াল থেকে সাড়া লাভ করে, আস্তে-সুস্থে পরিকল্পনাটা বাগিয়ে নেয়, তারপর অরণ্যের সামনে একটা পছন্দমতো অবস্থানে দাঁড়িয়ে স্লো-মোশানে নিজেকে ক্রমশ বিবস্ত্র করে দিতে থাকে, সে দ্রৌপদী নয় যদিও, কারণ তার বস্ত্র অন্য কেউ নয়, হরণ করছে সে নিজেই, কোনোরূপ শব্দসমারোহ নেই, ঠোঁটে-মুখে কোনোই বিকার নেই, চোখ দু’টো গভীর কিছু পর্যবেক্ষণে রত, এ অর্থে যে, সে ইতোমধ্যে যে পরিকল্পনাটা এঁটেছে এবং পরিকল্পনামাফিক যে কর্মটা সে সারছে, তাতে প্রত্যাশিত ফলাফলটা আয়ত্তে আসছে কি না, অথবা এই ঘটনায় অরণ্য কীভাবে সাড়া দিচ্ছে

অরণ্য স্থির নিশ্চিত যে তার সামনেটা অন্ধকার, অঙ্কের হিসেব, কাজেই নড়চড় হবার কথা নয়, কাব্যের কল্পনাবিলাসিতা গণিত কোনোদিন টলারেট করে না, গণিতবিদেরা নিজেরা ভেতরে-ভেতরে কল্পনাবিলাসী ছিলেন এরকম হতে পারে, কিন্তু সূত্র আবিষ্কারে ভেতরকার সে কল্পনাবিলাসিতাকে প্রত্যক্ষভাবে কাজে লাগিয়েছেন এরকম ভাবা যায় না, যেহেতু দুয়ে দুয়ে চার না-লিখে পাঁচ লিখলেও কাব্যের সম্ভ্রমহানী ঘটে না কিন্তু গণিতের ঘটে, তো সামনে যদি নিশ্চিত অন্ধকার, তবে কী এমন দায় তার যে তাকে বেরোতেই হবে, যেখানে বাস তার সেখানটাও আলোময় নয়, কোনোদিন ছিল না এ ডালপাতাদের ভিড়ে, কিন্তু এখানে আর যাই হোক রাহা আছে, তার অন্ধকারের অবলম্বন, তাকে ছেড়ে এই ঘুটঘুটে পথে নেমে কী এমন রত্ন মিলবে, যা তার এরকম বোকামির ঘাটতিটাকে পুষিয়ে দেবে, তার ওপর ব্যাপারটা যেখানে নিশ্চিত যে সামনে অন্ধকার, নিশ্চিতি-অনিশ্চিতি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার ত্রুটি থাকতে পারে না, কেননা গণিতটা সে কমবেশি বোঝে, যতটা বুঝলে তেলটা-নুনটার হিসেবে কোনোদিন আটকাতে হয় না, ততটা গাণিতিক জ্ঞানই এ হিসেবের জন্যে যথেষ্ট, অতএব সে যাবে না, অচেনারা যে পাড়ায় থাকে, সেখানের তালগাছগুলো কেমন লম্বা, স্নানঘাটগুলো কেমন পরিচ্ছন্ন, এসব জানার জন্যে তাকে আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে, অন্তত কদিন স্থির থেকে দেখে নিতে হবে, নিশ্চিত যে অন্ধকারটা ফণা তুলে আছে, তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল কি না

রাহা এখন সম্পূর্ণ দিগম্বর তার শূন্যতম জন্মদিনের মতো, দু'পা ফাঁক করে সে নিঃশব্দে বসে গেল অরণ্যসকাশে, অরণ্য দেখল তার স্তন-যোনি-নিতম্ব সব কুৎসিত, ঘোর অন্ধকার, কালো, ভয়াবহ-- এগুলো এত চেনা ও ব্যবহৃত যে তার ঘেন্না ধরল, বিবশ চোখ দু'টো মুদে গেল এবং সহসাই জ্বলে উঠল আলো, চোখ বন্ধ করলে সামনে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায় সমুদ্র ও পাহাড়ের ঢাল, অরণ্যও দেখল, অচেনারা সবাই পথ আলো করে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, কেউ সেখানে নিবস্ত্রা নয়, রহস্য ঘনীভূত সেসবের শ্রী-অবয়বে, লোভাতুরা হাতছানি যেন, অরণ্য ভেবে ওঠে সুপারসনিক বেগে, এ রহস্যসমুদয় জানতে হবে, রাহাকে হয়েছে জানা, এবার অন্যে যাব ভবিষ্য আলোয়, সামনেই সিদ্ধি, বিড়বিড় করে উঠে দাঁড়ায় সে, চোখ মেলে এবং বাক্সপেটরা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অচেনার পথরেখা ধরে

রাহার এ সাফল্য তাকে তার যোগ্যতা সম্পর্কে আরেকটি নিশ্চিতি দেয়, নিজের প্রতি তার আস্থা বাড়ে, তার দরকার ছিল অরণ্যকে ঘরের বাইরে নেয়া, কেননা সে ভালোবাসে তাকে, এবং সে জানত যে কেবল এভাবেই তাকে রাজি করানো সম্ভব, এ সাফল্যে সে খুব খুশি হয়, সে নিশ্চিত যে, অরণ্য একদিন অচেনাকেও চিনে নেবে, ও তখন তাদেরও অপছন্দ করবে এবং ফিরে আসবে পুরানোয়, তার বুক জুড়ে, যেখানে ততদিনে অগেয় গীতসমেত অজস্র না-চেনা রহস্যপাখি জড়ো হবে দূরে থাকার সুবাদে, তার নিজস্ব অলিগলি ভরে উঠবে চাপ-চাপ সুস্বাদে, না-চেনা রহস্যপাখিদের এই অগেয় গীতসুধা পানতৃষ্ণায়ই অরণ্য সেদিন আবার তার হবে, রাহা জানে

পাতাদের ঝরে যাওয়া মানুষের অনিবার্য মৃত্যুরই প্রতীকী ব্যঞ্জনা

লোকটার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার কথা ছিল ইস্রাফিলের শিঙাটা বেজে-না-ওঠা পর্যন্ত, কিন্তু ব্যত্যয় ঘটাল পাখিটা, অনেক পাখি আছে পৃথিবীতে, স্বর্গেও থেকে থাকবে হয়ত, যাদের বেশ ভালো লাগে, কী রূপে কী গুণে, অথচ নাম জানা যায় না, এরকম একটা পাখিরই কাণ্ড ছিল এটি, আগে কখনো এ পাখিটার গান শুনেছিল কি না মনে করতে পারে না সে, তবে সে চোখ কচলাতে কচলাতে এমত ধারণা করে যে, পৃথিবীর মানুষ ততদিন অন্তত আনন্দকে বুঝবে, যতদিন এই জাদুর পাখিটা গাবে

তার যখন বাঁশের চাঙাড়ি ও নতুন করে গজিয়ে ওঠা মাসকালাই গাছে মোড়া মাটির আস্তরণ ভেদ করে উঠে আসতে হলো, সহসাই, প্রাক-বিবেচনা ব্যতিরেকে, তখন দুপুর, নদীর অন্তরে তখন নীল আকাশের ছায়া, আকাশের অন্তরে নদীর, আর তখন শনশন বাতাস বইছিল, আকাশের নীলশাড়ি তোলপাড় করে দিচ্ছিল রূপসী নদীর স্রোত, গ্রীষ্মের এরকম রোদেলা দুপুরে কবরের ভেতর ভ্যাপসা গরম থাকতেই পারে, কিন্তু সে কখনো এজন্যে নিজেকে নদীর দিকে বয়ে নিয়ে যাবার কথা ভাবে নি, কেননা পাখিটা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে এর মানে এ নয় যে তাকে হাঁটতেই হবে, মোটকথা নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে সে কখনোই কোনো কিছু করতে উদ্যত হয় নি, কাজেই আপনি বা আপনারা দয়া করে এমত ভাববেন না যে, লোকটা নিজস্ব কোনো স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অন্যত্র গমন করছিল, এবং এটা যে, পাখিরা সবসময় এ ধরনের কার্যক্রমে আনুকূল্য দিয়ে থাকে, সে যাচ্ছিল অথবা যাচ্ছিল না, যাচ্ছিল, কেননা সে প্রতিমুহূর্তে স্থানচ্যুত হচ্ছিল, যাচ্ছিল না, কেননা তার সামনে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল না, এবং তার ভাবনারা একাসন তথা নড়চড়হীন ছিল, পায়ের নিচে মচমচ করে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল শুকনো ঝরাপাতা, আর তার উপলব্ধিতে এসে ধাক্কা দিচ্ছিল এক ধরনের নাকী কান্নার সুর, যা অস্পষ্ট, এটি তাকে অন্যরকম করে ভাবাল, সে নিশ্চিত হলো যে, মৃত ও ইতোমধ্যে শুকনো এসব পাতা, যেগুলো দলিত হচ্ছে চারজোড়া পদ-সঞ্চালনে, সেসবের অন্তর্গত বেদনারা তার কর্ণকুহরে অসম্ভবরকম আকুতিময় অনুযোগ তুলছে

মৃতের কোনোরূপ বাদ-প্রতিবাদের শক্তি যে নেই, একথা তার চেয়ে বেশি আর কেউ বোঝে না বস্তুত, কেননা সে নিজে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, কেননা তার সকল প্রকার বাদ-বিসংবাদের ক্ষমতা ইতোমধ্যে রহিত হয়েছে, এরপরও তার এরকম ভাবনা রহস্যপূর্ণ তো বটেই, অবশ্য পৃথিবীতে ভাববার মতো এত বিষয় থাকতেও, এ মুহূর্তে ঝরাপাতা বিষয়ে ভাবাটা তার জন্যে প্রাসঙ্গিকও বটে, জঙ্গলে বাসজনিত কারণে বন্যপাখি, প্রাণী ও বৃক্ষাদি, সপ্তাহচারেক থেকে তাকে মাত্রাতিরিক্ত আচ্ছন্ন করে আছে, বন্যপ্রাণী বিষয়ে তার ভাবনা এ-যাবৎ বিমিশ্র, এরা চালাক ও একই সঙ্গে বোকা, যেমন এই শেয়াল দু'টো, যারা ধূর্ত খেতাবধারী অথচ চরম বোকামির পরিচয় দিচ্ছে এখন, তার মাংসহীন কঙ্কালটাকে আগ্রহভরে বহন করে, তবে পাখিদের ব্যাপারে তার ভাবনা সবসময় ইতিবাচক, এরা গান গায় আর ঘুম ভাঙায়, ঘুম ভাঙায় আর গান গায়

আপাতত পায়ের নিচে শুকনো পাতার মচমচ নেই, সে এবং তারা এখন নদী তীরবর্তী মোটামুটি বৃক্ষহীন একটা চালায়, কিন্তু কান্নার তীব্রতা তাকে আগের মতোই হানছে, বুঝল সে, এবং এ-ও বুঝল যে, এবার তার কিছু বলা দরকার পাতাদের উদ্দেশে, এই যে-- ‘অত চ্যাঁচিও না, আমাকে এবং তোমাদেরকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, তার নির্দেশেই তোমরা ঝরেছ, যেমন একদিন আমি ঝরেছি, যেদিন স্বর্গবৃক্ষ বর্জন করেছে আমার বৃত্তান্ত লেখা পত্রটি’, কিন্তু বলতে কি আসলে পারে সে, তার ঠোঁট নেই, জিহ্বা নেই, কণ্ঠ নেই, পচে-গলে গেছে

সামনেই জলপাই গাছ, বিস্ময় মানতে হয় বৈকি, এরকম স্থানে সে জলপাই গাছ জন্মাতে দেখে নি আগে, পৃথিবীতে, ঠিক নদীর ধারে, আগে দেখতে পেলে এ গাছের নিচে এসে বসা যেত, একা অথবা সস্ত্রীক, এর সমস্ত পাতাই সুন্দর যেগুলো সবুজ, আর যেগুলো মুমূর্ষু ও কমলা-লাল, আরো সুন্দর, আহা পৃথিবী, সে কি কোনো অংশে কম সুন্দর দেখবার চোখ থাকলে, এখানে যেমন নরকের ছায়াপাত ঘটে, তেমনি স্বর্গের, অবশ্য এ মুহূর্তে সে পৃথিবীতে স্বর্গের উপমা খুঁজতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে, যার একটিতে ঢুকবে বলে সে সপ্তাহচারেক ধরে রেওয়াজ সারছে, স্বর্গকে বিস্তারিত জানতে পারে নি সে এখনো, অন্ধের হস্তি দর্শনের মতো জেনেছে, মৃত্যুর দিনকয় পর একজন রহমতের ফেরেশতা তাকে নিয়ে গিয়েছিল স্বর্গের দরজা অবধি বোররাক এর মতো দ্রুততায়, আবার তার সঙ্গেই ফিরে এসেছে সে কবরে, মোটামুটি প্রাথমিক হিসেব-নিকেশ সেরে ফেলবার জন্যে, প্রতিদিনই কবরে তার কাছে বিভিন্ন ফেরেশতারা আসছেন বিচিত্র সব খাতাপত্র নিয়ে, পৃথিবীতে বাসকালীন তার অর্জিত পাপ ও পুণ্যগুলোর একত্র সন্নিবেশ ও যোগ বিয়োগের পালা শেষ হলেই মাটির বিছানা থেকে তার ছুটি হবে, কবরকে তার কাছে হাজতখানার মতো লাগছে, কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করে এখান থেকে সরে পড়বার পক্ষে সে, আর তাছাড়া সে জেনে গেছে, ছোটখাট যে পাপগুলো করেছে সে পৃথিবীতে, সেগুলো তার স্বর্গগমনকে বাধাগ্রস্ত করবে না, একজন মিশুক ফেরেশতা আগেভাগেই তার কানে কথাটা বলে গেছেন, কেননা সে সৎকর্মে ব্রতাবস্থায় আততায়ীর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছে, সে জানে, যদিও এটা অনুমাননির্ভর, তবু বলা যায় যে তার সম্মানিত আততায়ী এখনো বেশ সুন্দরভাবে স্বাভাবিক বেঁচেবর্তে আছে, কেননা জগতের ওরা বেশ প্রভাবশালী সদস্য, প্রচুর প্রতিপত্তি আছে, আর সে যতদূর জেনে এসেছে পৃথিবীর রীতিনীতি, তাতে নিঃসন্দিগ্ধ হওয়া যায় যে, তার মৃত্যুর সঠিক রহস্যটি কোনোদিনই উন্মোচিত হবে না, কমবেশি যেখানে যা প্রযোজ্য, অর্থ দিয়ে যেকোনো ছিদ্রই বন্ধ করে দেয়া যায় পৃথিবীতে, কেবল এখানে, এখন সে যেখানে আছে, বাঁ'হাতের কারবারটা পুরোপুরি অচল, কেননা ফেরেশতাগণ উৎকোচ গ্রহণ করেন না, কাজেই সে এই ভেবে মনে-মনে আনন্দিত হয় যে, ওই লোকটি, যে তাকে অকারণে খুন করেছে, তারও একদিন এখানে আসতে হবে বুকপকেটে আদ্যন্ত গড়ের মাঠটাকে পুরে নিয়ে

জলপাই গাছটির নিচে এসে থামল বাহকদ্বয়, সে দেখল ওপর দিকে চেয়ে এবং ডানে-বাঁয়ে, ভালো লাগল আরেকবার, অন্যরকম, এরপর সে নদীর দিকে তাকিয়ে দেখল যে, সূর্যটা ঢেউয়ের তালে তালে খেলছে, কখনো বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, আবার জোড়া লেগে হয়ে যাচ্ছে আগেরটাই, এসময় একসাথে প্রায় তিনটে পাতা ঝরে পড়ল তার ওপর, শেয়াল দু'টো চমকাল, এমনকি সে নিজেও, যখন এইমাত্র ঝরা পাতা তিনটিও বনের ভেতরকার পাতাগুলোর মতো নাকী কান্না জুড়ে দিল, ব্যাপারটা ঘটল তখনই, গাছে যেসব পাতা অপেক্ষায় ছিল ঝরে পড়বার, কমলা-লাল, কোরাসে গেয়ে উঠল গয়বিসংগীত-- ‘সবুজ ফিরায়ে দাও-- সহসা ঝরব না, আনি তো সুসাম্য-- করি তো প্রার্থনা, আমাদের এ প্রয়াণ-- নিসর্গে কাম্য না’-- এবার অবশ্যই তার কিছু বলা প্রয়োজন, অনুভব করল সে, এবং হঠাৎ সূত্রটাও পেয়ে গেল, মনে পড়ল, তার চোখ নেই কিন্তু সে সব দেখতে পাচ্ছে, কান নেই কিন্তু শুনতে পাচ্ছে, মস্তিষ্ক নেই কিন্তু ভাবতে পারছে, অতএব যৌক্তিকভাবে তার বলতে পারাটাও উচিত, এবং তা কোনোভাবে সম্ভব হয়ে উঠতেও পারে

অকস্মাৎ নড়ে উঠল কঙ্কালটা, আর তার ভেতর থেকে গমগম আওয়াজ উঠল আধিদৈবিক-- ‘তোমাদের ঝরে পড়া মানুষের অনিবার্য মৃত্যুরই প্রতীকী ব্যঞ্জনা...’, শেয়াল দু'টো তখন ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়াতে থাকল দুই বিপরীত দিকে

Tuesday, January 29, 2008

উদ্ভিদের উৎকৃষ্ট প্রতিবেশী না-থাকাটা দোষের বটে

যতটা উচ্চাশায় এই ভরা রোদের দুপুরে অ্যাডভেঞ্চারের নেশাকে বগলে নিয়ে এতদূরে এসেছিল তিতির, কোনোরূপ পরিকল্পনা ব্যতিরেকে, হুট করেই, স্বতঃস্ফূর্ত কবিতার শব্দের মতো মোলায়েম পদপ্রক্ষেপণে, ততটা আশাকে সে পুষ্পমাল্য পরাতে পারে নি, অর্থাৎ ভ্রমণটা সম্পূর্ণাঙ্গ হয় নি তার, গোটা বাগানে নতুন করে চিনবার মতো গাছ সে খুব কমই পেয়েছে, অবশ্য লিগুমেনুসি গোত্রের সেলটিস-খয়ের আর অজ্ঞাতকুলশীল আকাশমণি ও বুনোবুবির সাথে এখানেই তার প্রথম পরিচয়, পাম ও অয়েলপামের পার্থক্যটা এখানে না এলে কুয়াশাবৃতই থেকে যেত হয়ত, থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ গাছে কোনো নামফলক নেই, কিন্তু উদয়পদ্মের ঝোঁপে ছিল, আর এতে সে এমন আনন্দিত হয় যে, গোটা পৃথিবীটাই তার স্মৃতিতে চেনা-চেনা লাগে, এ জাতের পোড়ামাটিরঙা চামচসদৃশ বাঁকা মোটাপাতার গাছ তার প্রতিদিনের শহরে অনেক দেখেছে সে, যদিও নাম জানত না আগে, অনেক গাছের নাম-পরিচয় যেমন অন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনেছে, তেমনি এটিও সে জেনে নিতে পারত, কিন্তু মানুষের কাছে কত জিজ্ঞেস করা যায়, আর তাছাড়া জিজ্ঞেস করলেও উত্তর পাবার নিশ্চয়তা সর্বদাই হয় পঞ্চাশ শতাংশেরও নিচে, এটা সে এতদিনকার অভিজ্ঞতায় জেনেছে হাড়েহাড়ে, এটা খুব আত্মমগ্নতার কাল, সে জানে, এবং জিজ্ঞাসা শুনে কাঁচুমাচু শ্রোতার কাহিল অবস্থা দেখবার তার আর রুচি হয় না, এই অবস্থা দেখলে নিজেরই লজ্জা হয়

এসব নেশায় পাবার পর থেকে অভিজ্ঞতার্জনের পাশাপাশি একটা জরিপও সেরেছে তিতির, যার ফলাফল দেখে সে বিস্ময়ে ফালা ফালা, উদ্ভিদ সম্পর্কে ভালো জানেন, এমন মানুষ শয়ে মাত্র দু'জন, গাছপালা সম্পর্কে কিঞ্চিদধিক ভাবনা-চিন্তা করেন, এমন মানুষ শয়ে সাতজন, আর বাকি একানব্বইজন দু'পায়ে মাড়িয়ে যাচ্ছেন যাদের, জীবকুলে তাদেরও যে বাঁচবার অধিকার আছে, তাদেরও যে সুখদুঃখ আছে, ভাবেন না মোটেই, সে নিজে শয়ে দু'জনের কোটায় পদোন্নতি আশা করে, নিজেকে সে বৃক্ষের একজন উৎকৃষ্ট প্রতিবেশী ভাবতে চায়, তার মতে বৃক্ষ এখন অকৃতজ্ঞ প্রতিবেশী পরিবৃত, অথচ পৃথিবীকে আর কিছুদিন বাঁচতে দিতে চাইলে, উদ্ভিদের উৎকৃষ্ট প্রতিবেশী থাকাটা অতীব জরুরি, এহেন গণিতাচ্ছন্নতার এক পর্যায়ে হঠাৎ তিতিরের মনে পড়ে যায় কল্কেফুলের মতো হলুদ বয়সকে, সে বয়সের শাদা জবা চিনতে যাবার দিনের ঘটনাটা তাকে দোলায়িত করে আজো, কিছু-কিছু দিন থাকে কোজাগরী রাতের মতো স্মৃতিতে ডাগর, ওটা ছিল সেরকমই একটা দিন, কী রোদ সেদিন পথে-পথে, আকাশ চুঁইয়ে যেন আগুন ঝরছিল পৃথিবীতে বৃষ্টির ফোঁটার প্রায়, শাদা বাড়ির অনুষঙ্গে কী শাদাই না লাগছিল ফুলগুলি, নীল গেট, আহা নীল অপরাজিতা, আর সেদিন অনুপম ভাষায় কথা বলেছিল চুলের বেণী, পৃথিবী সেদিন তার দিকে অন্যরকমভাবে তাকিয়েছিল, সে অতঃপর ভয়ে-ভয়ে আনন্দে চিৎকার করে, জগতের সর্বাধিক স্বচ্ছন্দ কায়দায় জাপটে ধরেছিল ধরিত্রীকে কামার্ত কলায়

শাদার বন্যা ছিল সেদিন চারপাশে, পৌরপথগুলোও পিচের অধিক শাদা হয়ে উঠেছিল রৌদ্রনৃত্যে, এরকম হয় না সাধারণত, কিন্তু হলো, হঠাৎই রোদকে খুব অপ্রিয় মনে হলো তার, ভিটামিন ডি-এর জন্যে মৃদু রোদই যথেষ্ট, কেবল এর দোহাই দিয়ে, এত বৈরী যার আচরণ, খরখরে, আজ অন্তত মিত্র ভাবতে পারল না, বরং ছায়া দরকার, যদি চরম উত্তেজনাটা কোনো এক জায়গায় ব্যাহত না হতো, তবে রোদ মিঠা কী ঝাল কী টক, এ ভাবনার মনে উদয়ই হতো না, কিন্তু আসলে হয়েছে যখন, তখন সাপখোপের সম্ভাবনা টপকে, অপেক্ষাকৃত ঘন জঙ্গলে সে ঢুকে গেল ছায়াপাড়ায়, হঠাৎ নড়ে উঠল এক দঙ্গল ঝোঁপ, যার নিচে দু'জন মানুষ জাপটাজাপটি শুয়ে, একজনের পুরুষ্ট গোঁফ আরেকজনের স্তন, তিতির কথা বলে, পাখি আমি, ডালে ডালে ফিরি, আমাকে লজ্জার কী গো, তারা তখন শামুকের মতো গুটিয়ে এল পরস্পরের দিকে, হাঁফ ছাড়ল তিতির, তখন সে গোড়ানিমতলে, জামায় লেগে যাওয়া আলবিদার ডালটা ছাড়াচ্ছিল, বুনোফুল, আহা অনুপম, কী একটা জগৎ, এলেবেলে, আর বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎই নরোম কাদায় পা, এত নরোম যেন কিশোরীর স্তন, পা কেবল দাবতেই থাকল, দাবতেই থাকল

নদীর সাথে গাঙচিলের ভাবপর্বের সমন্বয়ক ছিপবাঁশের ছোট্ট সোনামণির মতো সুন্দর গোড়াটিতেই বসা ছিল ছেলেগুলো, তাস হাতে জনাচার, আর তাদের দর্শক হয়ে জনাতিন, কী যে হলো-না-হলো, সহসাই ওই ওঁৎসপ্তক চমকে দিয়ে গাছের সব পাখপাখালি, ঝাঁক ঝাঁক শকুনের মতো টাকি দৌড়ে ছুটল লিগুমেনুসি ঝোঁপটার দিকে, তিতির হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে চা গাছের পাতায় হাত বুলাতে বুলাতে ভাবল শকুনদের কথা, আচ্ছা, শকুনদের মরার অত নির্ভুল সংবাদ কে বা কারা পৌঁছে দেয়, মাছি না অন্য কেউ...

চা-পাতারা এর কোনোই জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করল না

চরম ব্যস্ততার ভেতর আরেকটা কাজ বেড়ে যাওয়া ভারি বিব্রতকর

ওরা দু'জন এখন যে স্থানটিতে উপবিষ্ট, সে স্থানটিতে এর, সাতবছরের পুরানো বিব্রতিমিশ্রিত আনন্দের স্মৃতি আছে, স্থানটির সামনে যথাক্রমে বাইশহাত খাড়া ঢাল, দুশ’ গজ গুঁড়ো ঢেউযুক্ত নদী, আড়াইশ’ গজ শাদা কাশচর, সত্তর গজ শীর্ণ নদী, তিনটে সবুজ বাড়ি ও অসীম দিগন্ত-- পেছনে যথাক্রমে সাতহাত খাড়ি, বিশহাত ঘাসপার্ক, ফুটের হিসেবে ৫৪ ক্ষেত্রফলযুক্ত আটচালা বিশ্রামাগার, ৩৬ ক্ষেত্রফলযুক্ত অকেজো কৃত্রিম প্রস্রবণ, সাড়েচারহাত আরবান পথ, আওড়ি কাঁটা ও সরকারি বাংলো-- ওরা দু'জন বালক-বালিকা, ইন্টারমিডিয়েট বয়স, নাম নেই অথবা জানা নেই-- ধরা যাক একজনের নাম গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, আরেকজনের অনন্ত বিকেল, ‘এর’ বলতে যাকে বোঝানো হচ্ছে, সে একজন দায়হীন পর্যবেক্ষক, ভবঘুরে ছেলে, নিয়ত সংক্রমণের ভেতর বেড়ে ওঠা ও বসবাসরত, বয়স পঁচিশ, নেশাখোর বলা যায় তবে নেশাতে আসক্তি নেই, কোনো অবস্থাতেই পাগল বলা সঙ্গত নয়, কিন্তু অনেকে বলে, গ্রামের সরলপ্রাণরা বলে মাস্টরসাব, কেউ কেউ কবি বলে, কেউবা সাংবাদিক

ধরা যাক ভবঘুরের নাম নীরব গোধূলি, তো গোধূলি যখন এল শেষপ্রায় বিড়ি টানতে টানতে, তখন বৃষ্টি ও বিকেল জড়াজড়ি করে আছে, ওদের মাঝে কোনোই দূরত্ব নেই, গাছের গুঁড়িতে বসা, গোধূলি ভাবল, বিকেল কেন থাকছে এখনো, তার অবশ্যই চলে যাওয়া উচিত, শেষ রোদ যখন কাশবনে জাদু দেখিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, পাখিরা যখন চর ছেড়ে ফিরে আসছে তীরগাছায়, তখন তো বিকেলের থেকে যাওয়াটা কোনোভাবেই টলারেট করা যায় না, প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী বৃষ্টি এখন পুরোটা গোধূলির, যদি রোদ সূর্যের হয়, রঙধনু আকাশের

ঘাসেরা একদিন বলাবলি করছিল খুব, দূর থেকে শোনা, যে, বৃষ্টি ও বিকেলে রক্তৈক্য আছে, সম-আধান, দু'জনে অতএব বিকর্ষণই সম্মত চুম্বকের ধর্মানুসারে-- বিকেল মামা, বৃষ্টি ভাগ্নি, কিন্তু আজ যা দেখছে গোধূলি, তাতে তার আরেকবার অন্তত ল্যাবরেটরি রুমে না ঢুকে উপায় নেই, গিয়ে দেখতে হবে যে আসলে ওদের সম্পর্কটা কীসের ভিত্তিতে রচিত, আকর্ষণের না বিকর্ষণের, আরেকটা কাজ বেড়ে গেল, একথা ভাবতে-ভাবতে দক্ষিণমুখো আটগজ হাঁটল গোধূলি, বৃষ্টি বাঁচিয়ে দাঁড়াল এসে অষ্টভুজাকৃতির বিশ্রামাগারে, ইচ্ছে করছিল না খেতে, তবু ওখানে থাকা ফেরিবাজ ছেলেটার থেকে দু'টাকার মটরদানা কিনে হাতে নিতে-নিতে আলগোছে তাকাল পেছনে, দেখল, নিরাপদ বটে ওদের থেকে স্থানটা, এখান থেকে কেবল বৃষ্টি ও বিকেলের কেশাগ্রভাগ দেখা যায়, ওরা লজ্জায় পড়বে না, গোধূলির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটাই এমন যে সে নিজে থেকে আপন অস্তিত্বটা বিজ্ঞাপিত করতে চায় না, অতএব লুকিয়ে-চরিয়ে হাঁটে, নীরব থাকে, যেজন্যে যাপিত জীবনে তাকে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত থাকতে হয়েছে, মাঝে মাঝে এ বৈশিষ্ট্যটার জন্য তার নিজের প্রতি রাগ হলেও এ খাদ থেকে উদ্ধারের জন্য কখনো কোনো চেষ্টাই সে করে নি, তা হোক, এসব নিয়ে সে দুশ্চিন্তা করে না, এ বিশ্বাসটা তার পুরোমাত্রাই আছে যে, তার যা প্রাপ্তি তা তাকে ফিরিয়ে দিতেই হবে এবং অন্যেরা সেটা তাকে দেবে, কেননা পরধন-লোভ অনৈতিক, যে প্রকৃতি তাবৎ শিল্পের শিক্ষক, তার ভেতরে এমন অজাচারী কার্যকলাপ পাত্তা পেতে পারে না, গোধূলি অতঃপর হাঁটতে লাগল অস্তাচলের দিকে, এই ভেবে যে, যতক্ষণ অন্তত বিকেল না উঠছে গাছের গুঁড়িটা ছেড়ে, ততক্ষণ ওদিকটা অন্তত বেড়িয়ে আসা যায়, যেদিকে রাত্রিরা ঘরদোর করে থাকে-- ইত্যবসরে দু'টো ঘটনা ঘটল, আকস্মিক এবং কাকতালীয়, মুহূর্তে গোধূলি ভেবে উঠল যে এগুলো তার সাপোর্ট, প্রকৃতিতে কোনো অনিয়ম চলতে থাকলে জীবকুলে দুর্ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক, মুহুর্মুহু, একের পর এক

অষ্টম শ্রেণি ঘেঁষা কিশোর, স্কুলের ইউনিফর্ম পরা, সাইকেলে দীর্ঘ ঢালু খাড়ি পাড়ি দিতে গিয়ে, উলটে কৃতিত্ব দেখাল, এই অর্থে যে, সে ভবিষ্যতে ভালো জিমন্যাস্ট হবে, আরেকটি ঘটনা ঘটল বছর নয়ের অপুষ্টিগ্রস্ত বালকের ক্ষেত্রে, হাফপ্যান্টের সাথে ইন করে শার্ট পরেছে যে, এবং যার খালি পা কুষ্ঠের শাদা দাগে ভর্তি, তেলতেলে, আনমনে নদী দেখছিল সে, হঠাৎ কী জানি কী দেখে এত উল্লসিত হয়ে উঠল যে, হাস্যার্থে চিৎকার করে দু'হাত ইংরেজি ভি বর্ণাকৃতিতে ঊর্ধ্বোত্তোলিত করে ঘুরতে থাকল, এবং এভাবে বড়োজোর তিনটা পাক খেতেই, ধপাস করে পড়ল গিয়ে শহর থেকে নদীতে নেমে আসা বর্জ্যজলবাহী নালার মধ্যে, এ বিয়োগান্তক দৃশ্য দেখে জলতলে স্থূল নিতম্ব ভাসিয়ে দেয়া শুশুককুলের মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল কিংবা আকাশপাড়ার চেনামুখ অতীব স্মার্ট ভুবনচিলরা শব্দ করে হেসেছিল কি না, তা কখনো জানা যায় নি

মটরদানাগুলো কী এক অদৃশ্য কারণে তিতকুটে লাগছিল তার, ঠিক সেদিনের মতো, গোধূলি ভাবে, ছেলেটাকে পেলে বলতে হবে যে মটরদানাগুলো সে যেন ফিরিয়ে নেয়, টাকাটা অবশ্য ফিরিয়ে চাবে না সে, এমন একটা প্রতিবাদ সে শিখেছে, যাতে হাতমুখ খারাপ না করেও ‘যারে-দেখতে-নারি’র চলনকে বাঁকা ঠাওরানো যায়, তা প্রায় তখন থেকে, প্রেম করতে শিখেছে যখন লালিমার সাথে-- পেছনে ফিরে সে দেখতে চায়, এ তল্লাটে ছেলেটা আছে কি না, কিন্তু চোখ দু’টো তার এ কাজে মনোযোগী হতে পারে না, দৃষ্টি ফেরায় নিয়ে গামারিতলায়, দেখে, ওরা দু'জন, বৃষ্টি ও বিকেল, এখন বেজায় বিব্রতকর অবস্থার ভেতরে নিপতিত, ব্যাপারটা এই এতদূর থেকেও বেশ বোঝা যাচ্ছে, বখাটেদের উৎপাত সাতবছর আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে দেখা যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হয়ত থেকে যাবে, যদিও সে চায় সব মানুষই একদিন অন্তত এ পর্যায়ে এসে দাঁড়াবে যে, অন্যের অধিকারের ব্যাপারটাকে তারা গুরুত্ব দেবে, বখাটেগুলো সেদিনের মতোই পেছন থেকে ওদের লক্ষ্ করে এটা-ওটা বলাবলি করছে, চিৎকার চ্যাঁচামেচি করছে, শিস দিচ্ছে, ঘটনার আকস্মিকতায় বিকেলের হাতে তার পরিচয়পত্র ঝলসে ওঠে, বাহ সে কি এখন উঠবে, অন্তত তার ওঠা উচিত, বৃষ্টিকে জাপটে ধরে এরপরও বসে থাকা ঠিক নয়, নইলে হীতে বিপরীত কিছু একটাও ঘটে যেতে পারে

নদীর ওপার থেকে যখন সর্বশেষ পাখির ঝাঁকটি উড়াল দেয়, ঠিক তখন ওঠে বিকেল, মেদবহুল মানুষের মতো ধীরেসুস্থে, এবং কী আশ্চর্য, হাত ধরাধরি করে বৃষ্টিও, গোধূলির মনে হয়, পৃথিবীতে তার জন্যে কোনো টেকসই ঠাঁইবাহুল্য নেই, লালিমা তাকে ছেড়ে গেছে সেই কবে, বৃষ্টি সে-ও গেল, ভাবতে-ভাবতে সে তাকিয়ে দেখে, ততক্ষণে রাত্রির ঘরের দরজা-জানালা খুলে যাচ্ছে পটাপট, এবং পৃথিবীময় জ্বলে উঠছে অজস্রাজস্র সান্ধ্য-আলোক

স্বপ্নবিজ্ঞান অথবা একটি আষাঢ়ে গল্পের খসড়া

পাড়াতুতো অনুজদের সামনেটায় সবচে' উঁচু আসনে বসে গাঁজারেট ফুঁকতে-ফুঁকতে বেশ আয়েস করে আলাপ জুড়ে অন্তু-- জানিস, স্বপ্নে যেদিন আমি প্রথম বিমানে চড়লাম, কখন, কোথায়, কীভাবে সেটা সম্ভব হলো, তা জানতেই পারি নি একেবারে, শুধু বুঝলাম যে বিমানে চড়েছি, যদিও বিমানটি যথেষ্ট আরামপ্রদ নয়, ভাঙাচোরা, খটরখটর শব্দ হয়, হেলেদুলে চলে, যেখানে-সেখানে থামে, যার ইচ্ছে ভেতরে বসে বিড়ি ফুঁকতে পারে, চালককে বলে প্রস্রাব করতে যাওয়া যায়, এমনকি...

আচ্ছা, এটা বিমান না কি ফুলবাইড়্যার বাস-- জিজ্ঞাসার বাণ ছুড়ে বুলেট--

তার দিকে বাঁহাত উচিয়ে না-বোধক একটা ইঙ্গিত করে বলতে থাকে অন্তু-- আরে শোন্ না আগে, স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করে যে ইন্দ্রিয়, সে আমার লোকাল বাসের অভিজ্ঞতাকে নিয়ে বিমানের ওপরে আরোপ করেছে, এ কথাটাই হয়ত তথ্য-উপাত্ত সহযোগে অন্যভাবে বলতে চাচ্ছিলি তুই, স্বপ্নেন্দ্রিয়ের এই স্বেচ্ছাচারিতাকে যাই বলিস, আমি দারুণ এনজয় করি

বিমানের প্রকৃত যাত্রী হবার কোনো সুযোগ এ-যাবৎ ঘটে নি অন্তুর, তাই বলে নিজেকে সে খুব অনাধুনিক মনে করে না, স্বপ্নের মধ্যে এরকম একটি কাঙ্ক্ষাবীজ অবশ্য সর্বদাই রয়ে গেছে তার, বিমানের অন্য অযাত্রীদেরও হয়ত তাই, বৃহৎ কোনো সময় পরিসর নিয়ে এ কাঙ্ক্ষাটি কাউকে ব্যস্ত না রাখলেও হয়ত তা নিয়মিতই বাঁচে মানুষের চিন্তার ভেতরে (স্বপ্নগুলো দানা বাঁধে কোথায়-- মস্তিষ্কে, মনে নাকি স্কন্ধে)-- আর চিন্তায় যা থাকে তাই-ই তো আসে স্বপ্নে, সবাই জানে স্বপ্নে যা সংঘটিত হয়, তার কোনো আগা-মাথা থাকে না প্রায়শই, পরম্পরাহীন এসব ঘটনা আনাড়ির হাতে বাজানো পিয়ানোর সুরের মতো প্রায়, স্বাভাবিকের চেয়ে সুপরিসর কোনো অস্বাভাবিকতা কি নিয়ন্ত্রণ করে সেই স্বপ্নক্রম, নাকি মানসিক কোনো ক্লান্তি-- এসব জিজ্ঞাসা আজ সকাল থেকে অন্তুকে ভাবাচ্ছে খুব

একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে সে-- তো হলো কী জানিস, অন্য অনেকের মতো আমিও প্রস্রাবের কথা বলে নেমে গেলাম বিমান থেকে, আসলে মোটেই আমার মধ্যে প্রস্রাবের চাপ তৈরি হয় নি, ওপর থেকে দেখছিলাম সবুজ ইউনিফর্ম পরা বালিকা-অধ্যুষিত একটি বিদ্যালয়, নেমেই টুক করে এসে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ঝাল-লবণ দিয়ে বাদাম খাচ্ছিলাম আর মেয়ে দেখছিলাম, জানিসই তো, টিন-এজ বালিকারা হয় ভয়ানকরকম কামকাতর আর দুষ্টু, একবার জিহ্বা দেখায় তো একবার মারে চোখ টিপ, এসব কাণ্ড-কারখানা দেখে একবার আমি গরম হই, একবার ঘামি, কখনো আবার ভ্যাংচানো দেখে আত্মায় পানিই থাকে না, তো হঠাৎ করল কী, কয়েকজন মিলে নাচতে-নাচতে গলা মেলাল ব্যান্ডের গানে

মারবে না, এরকম শাহরুখ খান মার্কা চেহারা নিয়ে গার্লস স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে হিরোগিরি করলে ঐশ্বরিয়া রাইদের জিহ্বায় তো পানি আসবেই-- ছোকরাদের মধ্যে সবচে’ বেপরোয়া রঞ্জু বলল

রঞ্জুর এই টিপ্পনীও অন্তুকে দমাতে পারল না, কোনো জবাবও করল না এর, সে-যে শাহরুখ খানের চেয়ে চেহারায় আসলেই কম নয়, হাসিতে এরকম একটা ভাব এনে আবার শুরু করল-- পরে কী হলো জানিস, শীতের সবজির মতো এসব বালিকাদের দেখে, আমি তো শালার ভুলেই গেছি যে বিমান দাঁড় করিয়ে রেখে আমি মুততে নেমেছি, খটখট শব্দ শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি বিমানটা পাখা মেলে দিয়েছে, বেশ দেরি করে ফেলেছিলাম আসলে, লোকাল বিমান হোক, ওদেরও তো একটা সময়জ্ঞান আছে নাকি, তো এখন আমি কী করব, দৌড়াব নাকি বিমানযাত্রার কথা ভুলে ইঙ্গিতে বালিকাদের ওইসব চুষব, এইমতো একটা লজ্জাচ্ছন্ন কিংকর্তব্যবিমূঢ়তায় আক্রান্ত হলাম আমি, শেষে সাত-পাঁচ ভেবে সটকে পড়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম, দিলাম ভোঁ দৌড়

মেয়েরা হেসে উঠল না বস-- জিজ্ঞাসা করল লিটু

হাসল না মানে, ওদের ব্যঙ্গের হাসি আমাকে পেছন থেকে কষে চাবুক মারছিল যেন, তাছাড়া ধর ধর বলে একটা আওয়াজও ভেসে আসছিল পেছন দিক থেকে, একবার যখন দৌড়েছি, বিমান ধরবার জন্যে না হোক আত্মরক্ষার জন্যে হলেও আমার দৌড়ানো দরকার, নইলে সবাই ধরে আচ্ছা করে পিটুনি দিয়ে ছাড়লে কী এমন করার থাকবে আমার, তো করলাম কী, চিৎকার করে চালকের নাম ধরে মোটা-সোটা ধুমসা একেকটা গালি ঝাড়ছি এবং বিমানের গতিপথের দিকে দৌড়াচ্ছি তো দৌড়াচ্ছিই। সামনে যত দালান-কোঠা, গাছপালা, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত পড়ছে, কিছুই আমাকে ঠেকাতে পারছে না

তার মানে-- সন্দেহ করে বসল রঞ্জু, পাহাড়-পর্বত ডিঙানোও সম্ভব নাকি, কীসব গাঁজাখুরি কথাবার্তা

অন্তু কথকের দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, অই, এজন্যেই তোদের সঙ্গে আমি বসতে চাই না, তুইও খাবি নাকি একটু, নে, দে দুটান, দেখবি একটুও গাঁজাখুরি মনে হবে না-- অন্তু গাঁজারেটটা বাড়িয়ে ধরে সামনে, কিন্তু এদের কেউই ওর সামনে নির্দোষ সিগারেটেও টান পর্যন্ত দেয় না, গাঁজা তো দূর অস্ত-- পাড়ার বড়োভাই, নিজেদের মান নিজেরা না রাখলে, বাজারে কি আর কিনতে পাওয়া যাবে, তাই আরেকজন, লিটু, রঞ্জুর মাথায় 'এই তুই থাম' বলে আলতো করে তর্জনি ঠুকে বলল, অন্তু ভাই আপনি বলেন...

অন্তু বলতে শুরু করে-- বিমান ছুটে যত দ্রুত, আমিও তত, চালক ব্যাটা আমার সাথে ঠাট্টা করছে মনে করে ওর ওপর বেশ খাপ্পা হয়ে উঠলাম, মনে-মনে ওকে শায়েস্তা করবার একটা ফিকির আমার মধ্যে কাজ করতে থাকল, হঠাৎ মনে পড়ল সামরিক প্রদর্শনীতে দেখা ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের কথা, কুড়িয়ে নিলাম একটা ইটের টুকরা, ভূপাতিত করার খেলো বাসনায় বিমানটি লক্ষ্য করে মারলাম ছুড়ে, রাগে ঢিল ছুড়ে মেরেছি, কিন্তু ওটার নিশানা এতটা অব্যর্থ হবে কে জানত

সত্যি সত্যি লেগে গেল

লাগল তো লাগলই, এমনকি কাজেও দিলো, ইটটা গিয়ে আঘাত হানল চালকের আসনের ঠিক পাশে, যে ব্যাটা চালাচ্ছিল বিমানটা, সে আসলে পাইলট না, ঢাকা শহরের বাসের চালকগুলোর মতো লাইসেন্সবিহীন হেলপার, সুযোগে চড়ে বসেছে চালকের আসনে, ব্যাটা তাই অভিজ্ঞতার অভাবে একটুতেই তড়াস খেয়ে গেল, যেই না ব্যাটা স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে জানালায় তাকিয়েছে কোত্থেকে ঢিলটি এল দেখতে, আর অমনি বিমানটি কাৎ, তো কাৎ বিমান সোজা করবার কৌশল শিখতে হলে মাথায় একটু ঘিলু তো থাকতে হয়, তাছাড়া অতটা সে ভেবেই উঠতে পারে নি যে হঠাৎ করেই চলন্ত বিমান কাৎ হয়ে যেতে পারে, এজন্যেই লোকজন বলে, খেতে চাইলে শুধু চিবুনো আর গেলা শিখলে চলে না, দাঁতের ফাঁক থেকে হাড়-কাঁটা বের করাও শিখতে হয়, যাহোক, ঢিলটি সইতে না পেরে বিমানটি ধেয়ে আসতে থাকল নিচের দিকে

গোল হয়ে বসা দর্শক-শ্রোতাদের সবারই চোখ কপালে উঠে এল, লোকটা বলে কী, বানাচ্ছে না তো, নেপাল বলে, হতেই পারে-- ঘটনাটা তো স্বপ্নের, স্বপ্নে তো আমিও একবার চেলসির সঙ্গে হাঁটছিলাম, ধানমণ্ডি লেকের পাশ দিয়ে, স্বপ্ন তো স্বপ্নই

নেপাল শেষ করার আগেই লিটু বলল, জানিস আমার কাছে চেলসিকে একদম ভালো লাগে না, পরীবাগ বস্তিতে ওরচে’ সুন্দরী অনেক মেয়ে আছে, ভালো পোশাক পরতে পারে না বলে ওদের চেহারার ঝলকটা সহজে চোখে পড়ে না, অবশ্য হিলারী ক্লিনটন তার মেয়ের চেয়ে এখনো অনেক বেশি সুন্দরী, আমি এরকম ভাবি বলেই স্বপ্নে চেলসি না হিলারীরই দেখা পেয়েছিলাম, হিলারী নিজ উদ্যোগেই আমাকে শাহবাগের মোড় থেকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে অত্তটুকুন দূরের ঢাকা ক্লাবে যান এবং আমাকে নিয়ে নাচেন, প্রথম দিকে আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম, কিন্তু অচিরেই আমি তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছি

তারপর কী হলো অন্তু ভাই-- বিমানে নিশ্চয়ই আগুন জ্বলে গেল, বলল নেপাল

বা রে, তোরাও তো মোটেই কম যাস না দেখি-- বিস্ময় মাখানো স্বরে বলল অন্তু, আমার সাথে পাল্লা দিচ্ছিস না তো, যাগকে, আমারটাই বলি, না রে নেপাইল্যা, মোটেই আগুন জ্বলল না, ধপাস করে আস্ত বিমানটাই এসে পড়ল দালানওয়ালা বাড়ির পুকুর পাড়ে, লাফ দিয়ে উঠে একটা ব্যাঙ যেভাবে পুনরায় ল্যান্ড করে, তেমনি করে ওটি বসে পড়ল মাটিতে, সংগত কারণেই যাত্রী-সাধারণের মধ্যে একটা হই-হট্টগোল শুরু হয়ে গেল, কিন্তু আশ্চর্য যে, কেউই মারা গেল না, কেবল কারো কারো হাত-পা ছিলে গেল, কারো-বা মন গেল ভড়কে, কারো হড়কে, চালককে 'চুদির ভাই' বলে গালি ঝাড়তেই সে বলল, 'আমি তো ভাবলাম আপনে থাইক্যা যাবাইন স্যার, ওঠেন ওঠেন'-- কষে আরেকবার 'চুদির ভাই' জপে আমি উঠে বসলাম, হেলপার-কাম-চালক-কাম-চুদির ভাই ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে এক নজর দেখে ট্রাক্টরের মতো খটখট শব্দ করে আবার উড়াল দিলো, আর আরাম করে পায়ের উপরে পা উঠিয়ে আমি টানতে থাকলাম সিগারেট-- কোনো অপারেশনে সাকসেসফুল হলে যেরকম হামবড়া ভাব জাগে চোখে মুখে, আমারও তখন তেমন

তারপর নিশ্চয়ই তোমার কাছে বিমানবালারা দৌড়ে এল, তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না তা জানতে-- খোঁচা মেরে বলল লিটু

ধ্যুত, লোকাল বিমানে আবার বিমানবালা থাকবে কীরে, ওটা তো পাঁচ টাকারও খেপ মারে, তবে হ্যাঁ, থাকলে থাকতেও পারত ফকিন্নির মতো ট্যাঁরা চোখা কোনো পথবালা ধরনের মেয়ে, কিন্তু জানিস, সিগারেটে টান দিয়েই আমার ঘুম ভেঙে গেল, জেগে দেখি কী, পা উঠে আছে খাটের হেড বোর্ডের উপর, লুঙ্গি নেমে গিয়ে হাঁ হয়ে আছে আমার জগৎসংসার

হে হে করে হেসে উঠল সবাই, নিজে বেশ গম্ভীর হয়ে মুথাটা বাঁ'হাতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, প্যান্টের সাইড পকেট থেকে পুরিয়া বের করে আরেকটা গাঁজারেট বানাতে মনোযোগী হলো অন্তু, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রোতাদের হাসি তেমন দীর্ঘজীবী হলো না, পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ওরা চারজনই উঠে দাঁড়াল, গাঁজা ভরতে-ভরতেই অন্তু খেঁকিয়ে উঠল-- এই, যাস কই চুদির ভাইরা, বয়, গল্পের তো মাত্র মুখটা বললাম, পাছাটা শুনবি না, শোন, আলুগাছের শাক খেতে বেশ মজা, তবে কিনা আসল মজাটা, মানে আলুটা তো থাকে মাটির নিচেই, এইবার তোদের আলুটা খাওয়াব, বয়, বয়

অনিচ্ছায়ও বসে পড়ে সবাই, পাড়ার সেরা মাস্তানকে উপেক্ষা করে চলে যাবে এমন সাহস এখনো জন্মায় নি কারো, সবাই অন্তুর মুখের দিকে তাকায়, সে অন্যদিকে তাকিয়ে গাঁজারেটটা ধরায় ও নাক-মুখ খিঁচিয়ে তিন-তিনটা টান হেকে দশাসই কেশে ওঠে, জানিস, গাঁজাটা হলো আমার ক্যালরি, যত বেশি গ্রহণ করি, তত বেশি শক্তি পাই, তত গল্প বানানো যায়, তাই বলে কখনো ভাবিস না যে, এতক্ষণ যে গল্পটা বললাম, সেটাও বানানো, বানানো গল্প আমি বলি অন্য পাড়ার ছেলেদের সামনে, হাজার হলেও তো তোরা আমার পাড়ারই পোলাপান, ছোট ভাই, তোদের মধ্যে তো আর ভেজাল মাল চালানো যায় না, কী বলিস, এইটুকুন কাণ্ডজ্ঞান যদি বিএ পাস করেও আমার না হয়ে থাকে তো ওরকম সার্টিফিকেটের দরকারটা কী আছে বল, তোদের মতো নকল করে তো আর পাস করি নি, এখন তো তোরা বই খুলে লিখিস..., বাক্যটি শেষ করেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্তু, কী যে দিন এল, গরু-বাছুরও তাদের অধিকার চাইতে শুরু করেছে, শুধু কি চাওয়া, জোর করে আদায় করে নিচ্ছে, অবশ্য যার যা পাওনা, সহজে না এলে তা আদায় করে নেয়াই সংগত আমার মতে

আচ্ছা রঞ্জু, নেপাল, লিটু, বুলেট তোরা সবাই তো মিন্টু কলেজেই আছিস, তাই না

সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, হ, অন্তু ভাই

ঠিক আছে, পরীক্ষার কয়েকদিন আগে আমারে মনে করাইয়া দিস, স্যারদের কইয়া দিমু নে, যাতে নকল করতে দেয়, না দিলে প্যাদাইয়া ফেলমু, এটা কোনো ব্যাপার না, এবার গল্প শোন-- লম্বা করে একটা টান দিয়ে আকাশের দিকে ধোঁয়ার একটা রিং নিক্ষেপ করে সে বলতে শুরু করে-- ঘুম থেকে যখন জাগলাম, তখন মাত্র ভোর ছয়টা, ছয়টার সময় ঘুম থেকে উঠব অতটা সিনসিয়ার কিংবা স্বাস্থ্যসচেতন পোলা তো আমি না, পাছার লুঙ্গিটা ঠিক করে, পা সোজা করে আবার ঘুমাবার জন্যে চোখ বুঁজলাম, মাথার মধ্যে বিমান যাত্রা, কচি বালিকা এসব ঘুরঘুর করতে থাকল, মনে মনে আবার বিমানে গিয়ে চড়ে নিচে আরো বালিকা বিদ্যালয় খুঁজতে থাকলাম, মনের মধ্যে যেহেতু বালিকা-বালিকা একটা ঘোর, নিচে যত নারকেল গাছ দেখি, সেসবকেও সবুজ ইউনিফর্ম পরা বালিকা বলে ভ্রম হয়, ভালো করে তাকিয়ে পরে নিশ্চিত হই যে, এটা কাঠের নারী, মাংসের না, যাহোক, ততক্ষণে আবার আমি ঘুমিয়ে গিয়ে থাকব

কোনো স্বপ্ন দেখা শেষ করে জেগে উঠলে আবার সেই স্বপ্নে ঢোকা যায় বলে তো শুনি নাই কখনো-- তীর্যক মন্তব্য ছুড়ল নেপাল

আরে ভোদাই, আগে শুনিস নাই এখন তো শুনলি, আমি যা বলি তা হানড্রেড পারসেন্ট কারেক্ট, মনে রাখিস, ঈশ্বর আমাকে এক্সেপশনাল মেধা দিয়েছে, ইন্টারমিডিয়েটে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া পোলা আমি, তোরা তো জানিস না কিছুই, মাথা ভরা শুধু গোবর

ঠিক আছে বলেন অন্তু ভাই, এই নেপাইল্যা তুই চুপ কর-- ধমকে ওঠে রঞ্জু

হঠাৎ আবিষ্কার করি কী, আমি পড়ে যাচ্ছি, কীভাবে ফস্কে গেলাম বলা মুশকিল, নিচ দিকে উঁকি দিতে গিয়ে কোনো জানালা খুলে নিয়েছিলাম কিনা জানি না, ভাঙা বিমান তো, চালকের হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজেও জানালা দরজা খোলা যায়, পড়ছি তো পড়ছিই, আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠল, ঘেমে একেবারে নেয়ে গেছি, মনে হলো, এই আমার শেষ, এত উঁচু থেকে নিচে পড়ে গেলে নিশ্চয়ই আমি আর বাঁচব না, তখনো শালার মেয়ের ঘোর কাটে নাই, একবার শখ হলো, পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে-- কোনো বালিকা বিদ্যালয়ে গিয়ে যাতে পড়ি, পরক্ষণেই আমার জানা একটা প্রবাদ মনে হলো, লুচ্চা মাথায় টুপি দিলেও লুচ্চা, নিজের ওপর ঘেন্না ধরে গেল, এখন তো মরে যাব আমি, এখনই, একবার অন্তত আল্লারে ডাকি, যদি রহম করে, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম-- ও আল্লা গো

সব চুপচাপ, বুলেটের মতোই কিছুক্ষণ পর শব্দ করে উঠল বুলেট, শেষ অন্তু ভাই

হ্যাঁ শেষ, তবে সব শেষ নয়, ততক্ষণে আমি খাট থেকে উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছি, শরীর ঘেমে জবজবে, দরোজায় প্রচণ্ড টোকা দিচ্ছে কেউ, একবার-দুবার-কয়েকবার, ওদিকে আমার তলপেট ফেটে যাবার উপক্রম, উঠতে গেছি, হাঁটুতে ব্যথা, কিন্তু শব্দ আর থামে না, শেষে গড়িয়ে গড়িয়ে দরোজার ছিটকিনি খুলতেই পাশের ফ্ল্যাটের তিন-চারজন নারী-পুরুষ একযোগে বলে উঠল, কী হয়েছে, চিৎকার করল কে

প্রথমে আমি বুঝতে পারলাম না, কিন্তু মেধাবী মানুষ বলে অচিরেই ঘটনাটার একটা ব্যাখ্যা আন্দাজ করলাম আমি, বললাম, চাচা, আপনারা যান, আমি একটু পরে আসতেছি, বলব, শুনতে চাইলে সব খুলে বলব, ওরা সন্দেহের চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে, রুমের ভেতর উঁকিঝুঁকি দিয়ে ধীরপদে চলে গেল, আমি প্রায় চোখবুঁজেই বাথরুমে ঢুকে তলপেটটা খালি করে আবারো গড়িয়ে পড়লাম বিছানায়

তারপর

তারপর কী, এগারটায় ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে চারটে খেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম, এসেই তোদের পেলাম, গাঁজা আর তোদের মতো বাধ্যশ্রোতার কল্যাণে গল্পটা মোটামুটি একটা শেপ পেল, লাঞ্চের পরে যাব পাশের ফ্ল্যাটে 'কী হয়েছে' প্রশ্নের জবাবি গল্পটা শোনাতে, বুঝলি, চাচার একটা সুন্দরী মেয়ে আছে, ওরকম সুন্দরী মেয়ের সামনে গল্প বলতে গিয়ে যদি আটকে যাই, সেটা ভারি লজ্জার ব্যাপার হবে, এজন্যে তোদের কয়েকজনের সামনে একটা দশাসই রিহের্সাল দিয়ে নিলাম

গল্পকার অমিত কহ্লার যেভাবে মিত কহ্লার হয়ে যায়

অমিত দেখল যে তার দুটো পৈতৃক হাতের একটিও আর অবশিষ্ট নেই-- বিস্ময়ে-বিষাদে সে দৌড়ে ম্যানসাইজ আরশির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লক্ষ করল যে হাত তো নেই-ই, এমনকি তার মুখটিরও প্রায় নেই-নেই অবস্থা-- কেমন যেন ঝাপসা, বিকৃত হয়ে যাওয়া, মেঘের আড়ালে অনুপ্রভা আলোভাণ্ডের প্রায় হারিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা যেন-- অতঃপর সে সঙ্গত কারণেই চিৎকার করল এবং ঢলে পড়ল আরশির সামনেই-- ঘুম থেকে জেগে দেখল যে, সে বিছানার পাশে মেঝেতে কুঁজো হয়ে শোয়া-- হাত না থাকার কথা মনে হতেই দ্রুত তাকাল ডানে বাঁয়ে-- না, হাত ঠিকই আছে, দুটোই-- তারপর উঠে প্রকৃতই দৌড়ে গেল আরশির সামনে-- না, মুখটিও আছে-- একটু যা ঘেমে নেয়ে যাওয়া, ক্লান্ত-- যাক, বাঁচা গেল-- ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল নটা পাঁচ-- অফিসে যাবার সময় ইতোমধ্যে উত্তীর্ণ-- সাধারণত সে আরো আগেই জাগে, আজ কেন যে এত দেরিতে ঘুম ভাঙল তার-- অদ্ভুতুড়ে এই স্বপ্নটা বোধকরি এজন্যেই-- বস আজ নিশ্চয়ই ক্ষেপে যাবেন-- এটা মনে হতেই দ্রুতহাতে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে গামছা কাঁধে ঢুকে গেল বাথরুমে-- কমোডে বসে আবারো মনে ভিড় করে এল স্বপ্নটির আদ্যোপান্ত-- ছি, কী বাজে ব্যাপার-- এমন স্বপ্নও মানুষ দেখে-- কোনো কার্যকারণ সূত্রই এর খুঁজে পায় না সে, ভুলেও যেতে পারে না-- ঠিক করে, এটা বরং একদিক থেকে ভালোই হলো যে বিদঘুটে এই স্বপ্নটা নিয়ে একটা দশাসই গল্প ফাঁদা যাবে এবং সেটা আজই

অমিত মানে অমিত কহ্লার-- গল্পকার, বাতাসের কাণ্ডকারখানা যাকে একদিন কিশোর বয়সে অলৌকিকভাবে লিখিয়ে নেয় বাতাসীর দুঃখবেদনা এবং যে পরবর্তী সতের দিনে আরো তিন তিনটি গল্পের খসড়ায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়-- তার একসময় মনে হয় যে, চাইলে সে একজন গল্পস্রষ্টা হিসেবে আবির্ভূত হতেও পারে-- যেই ভাবা সেই কাজ, রাতারাতি পিতৃপ্রদত্ত ‘অমিত রহমান’ নাম বদলে সে ‘অমিত কহ্লার’ হয়ে যায় এবং একজন ব্যস্ত লেখকের মতো দিনপাত করতে থাকে

কহ্লার মানে জলকে হাদিত করে যা, উৎপল, শালুক-- যে দেশে পর্যাপ্ত জলমহাল, সে দেশের একজন গল্পকারের সার্থক নাম ‘কহ্লার’ হওয়া তার কাছে যৌক্তিকই মনে হয়, নামপ্রভাব যেহেতু মানুষের মধ্যে গোপনে হলেও কাজ করে-- সে অতএব ধরে নেয় যে তার আদিনামের ‘অমিত’, তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেবে প্রচুর-- আর ‘কহ্লার’ হয়ত দু-তিনরকম মানে করবে অথবা ভূমিকা রাখবে পাঠকের মধ্যে-- কারো চিত্তসমুদ্র হ্লাদিত করবে, কাউকে বা সৌগন্ধিক শ্বেতোৎপল হয়ে বিমলানন্দ বিলাবে, কাউকে দেবে শালুক হয়ে জলোখাদ্যের নিশ্চয়তা-- এসব ভাবাভাবির চে’ বরং এখানে এ তথ্যটা দেয়াই জরুরি যে, এরপর থেকে অমিত কহ্লারের রাশি রাশি গল্পে ক্ষুধার মতো সত্য মানবিক-অভিপ্রায়ের পাশাপাশি কল্পরাজ্যের অতিমানবিক ফুলসমূহও ফুটতে থাকল যুগপৎ

একবার বন্ধুদের পরামর্শে বাছাই ছোটকাগজগুলোর কোনো-কোনোটিতে পাঠাল তার হ্লাদনমতাসম্পন্ন সৌন্দর্যময় খাদ্যগল্প-- ছাপা হয়ে গেল তার কোনো-কোনোটি-- নিন্দা যেমন জুটল তেমনি প্রশংসাও-- কিন্তু, অমিত কহ্লার আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করল যে, তার পাঠকরা তার গল্পে হ্লাদনা, সৌগন্ধ, সৌন্দর্য বা খাদ্য কোনোটারই নিশ্চয়তা পাচ্ছে না-- ঘটছে বরং উলটোটা, যেখানে সে যাচ্ছেতাই ভাষায় গল্প ফেঁদে অভ্যস্ত, সেখানে সে পেল চিত্তাকর্ষক-ক্রিয়াভিত্তিক-বহুরৈখিক-ডায়নামিক এবং নতুনতর এক গদ্যভাষার আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি-- এই বা কম কী, ভাবল সে এবং কলম চালিয়ে গেল যথাতথা, ক্রমশ পরিস্থিতি কিছুটা বদলাল, জৈবনিক চাকার ঘূর্ণনে চাকুরি সুবাদে কলম ছেড়ে কম্পু-সভ্যতায় নিল নিবিড় হাতেখড়ি, আগে যেখানে সে নিয়মিত গল্পকার ছিল-- এখন হয়ে উঠল অতিনিয়মিত-- মাথায় পোকার মতো কিলবিল করতে থাকা গল্পবীজ থেকে উদ্ভিদও গজাতে থাকল প্রতিদিন, অফিস কম্পিউটারে-- অবসরে

হন্তদন্ত হয়ে স্বপ্নে হাতমুখহারা হবার দিন সামান্য দেরিতে অফিসে গিয়ে চেয়ার টেনে বসবার আগেই সে দেখল যে তার টেবিলের সামনে একটি স্টিকার ঝুলছে-- ‘এই কম্পিউটারটির মালিক অ্যাড লিঙ্ক, গল্পকার অমিত কহ্লার নয় : ম্যানেজিং ডিরেক্টর’-- সহকর্মীর চোখের দিকে তাকাতেই সে বলল, বস আজ সকালে এসেই আপনার কম্পিউটারটি অন করেন এবং ‘অউন’ ডিরেক্টরিতে থাকা রাশি রাশি ফাইল ভর্তি এত ব্যক্তিগত কাজ দেখে খুব খ্যাপে যান-- তারপর তিনি নিজের হাতেই ওই স্টিকারটি কম্পোজ করে প্রিন্ট নেন এবং আমাকে লাগিয়ে দিতে বলেন-- আপনি এলে তিনি কম্পিউটার ধরবার আগেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন

অমিত কহ্লার গতরাতের ‘হাত নেই-মুখ নেই’ নামধেয় স্বপ্নটির কার্যকারণ এবার উপলব্ধি করতে পারে-- স্বপ্নের এই আগাম সঙ্কেত তাকে ভাবিত করে-- এটাকে সত্যিই একটা মজার ব্যাপার বলে মনে হয় তার-- যদিও তার আশঙ্কা হতে থাকে যে অহৃদ-অভদ্র ও নিয়তচণ্ড বস তার ফাইলগুলো সব ডিলিট করে দিয়ে গেছেন কি না-- নইলে কম্পিউটার ধরবার আগেই বা তার সঙ্গে দেখা করতে বলবেন কেন-- শরীরটা রাগে-আতঙ্কে-ভয়ে কাঁপতে থাকে তার-- সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করে না যে ফাইলগুলো আছে কী নেই-- নীরবে কিছু সময় ভেবে নিয়ে ‘ঠিক আছে আমি বসের রুমে যাচ্ছি’-- বলে সে হাঁটা দেয়

ডিরেক্টরের রুমের দরজার পর্দাটা সরাতেই তিনি ব্যঙ্গের সুরে বলে ওঠেন--
: আসুন গল্পকার অমিত কহ্লার, আপনাকেই আশা করছি-- বলছিলাম যে, এ-যাবৎ অফিসের প্রিন্টারে, ব্যক্তিগত কাজে, ধরুন গল্প, চিঠি ইত্যাদি মিলিয়ে আপনি যত পৃষ্ঠা প্রিন্ট নিয়েছেন তার কোনো হিসেব আছে আপনার কাছে
: জ্বি না হিসেব নেই, তবে করা সম্ভব
: হ্যাঁ হিসেবটা একটু করুন, আর শুনুন, যত কর্মঘণ্টা আপনি এই গল্পগুলো লিখবার কাজে ব্যয় করেছেন-- তারও একটা হিসেব দরকার-- ব্যয়িত অফিস উপকরণ এবং অফিস সময়ের অর্থমূল্য যা হয়, সে পরিমাণ টাকা আপনার বেতন থেকে কেটে রাখা হবে-- আপনার নিজস্ব যে ডিরেক্টরিটি ছিল সমুদয় ফাইলসহ ওটি আমি ডিলিট করে দিয়েছি-- নতুন করে আর কোনো গল্প লিখবেন না অবশ্যই-- একদমে এতগুলো কথা বলে তিনি অমিতের মুখের দিকে তাকালেন

অমিত আঁতকে উঠলেও মুখাকৃতিতে তার ছাপ পড়তে না-দিয়ে হালকা স্বরে বলল
: স্যার আপনি যে বেশ ঠাট্টাও করতে জানেন, এটা আগে জানতাম না
: আমি মোটেই ঠাট্টা করছি না
: সরি স্যার, তাহলে কি আমি ধরে নেব যে আপনি সিরিয়াসলিই কথাগুলো বলছেন
: আমি সবসময়ই সিরিয়াস কথা বলি, এবারও তাই বলেছি। আবার বলি, আমি সব ডিলিট করে দিয়েছি
: এতটা না করলেও তো পারতেন
: কেন, আপনার তো আর বাসায় একটা কম্পিউটার নেই যে ব্যাক-আপ নিয়ে নেবেন, শেষপর্যন্ত হতো কী ওগুলোর আবারো একটি করে প্রিন্ট নিতেন আপনি, সংরক্ষণ করবেন বলে-- সে সুযোগটি আমি রাখি নি
: কিন্তু আমার এতবড়ো সর্বনাশটি আপনি সত্যি-সত্যিই করে ফেলেছেন এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না
: শুনুন, প্রতিষ্ঠানের যে সর্বনাশটি আপনি করতে লেগেছিলেন, তার জবাব সর্বনাশ করেই দেয়া দরকার ছিল-- গম্ভীরভাবে বললেন বস
: কিন্তু আপনার ক্ষতি তো আপনি পুষিয়ে নিতে পারছেন, আমার বেতন থেকে টাকা কেটে রেখে-- আমারটা আমি কীভাবে পোষাব
: আবার লিখে নেবেন
অনেকটা কঠিন হয়ে অমিত বলে--
: বললেই হলো আবার লিখে নেবেন, লেখাটা অত সোজা হলে তো আপনিও লিখতেন-- যাকগে, আমি টোটাল হিসেবটা আজই আপনাকে দিচ্ছি-- আমার বেতন থেকে আপনি তা কেটে রাখবেন-- কিন্তু সেক্ষেত্রে আমার গল্পগুলো অবশ্যই ফেরত দিতে হবে
: শাসাচ্ছেন
: যদি তা মনে করেন, তবে তাই, কারণ ওগুলোই আমার একমাত্র অর্জন, আর কিছুই তো সঞ্চয় করি নি জীবনে
: যদি ওগুলো আপনার একমাত্র সঞ্চয়ই হবে, তবে অন্যের গোলায় রাখতে গেলেন কেন-- আগে সিন্দুক বানিয়ে তারপর তো স্বর্ণালঙ্কার গড়বেন
: না, আগে অলঙ্কার তারপর সিন্দুক-- আমি এভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত-- তা যাহোক, এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ-- আমি আমার গল্পগুলো ফেরত চাই
: সাট আপ
: ইউ সাট আপ, বলে, উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেল অমিত
: গেট আউট, আর শুনুন, কাল থেকে আপনার আর না আসলেও চলবে
: কী করে ভাবেন যে, পাগলা কুকুরের গলা জাপটে ধরে চুমো খাবার শখ আমার এরপরও থেকে যাবে, বলে রুম থেকে হনহনিয়ে বের হয়ে আসে অমিত

অফিসে ঘটে যাওয়া এতবড়ো সর্বনাশটি অমিত কহ্লারকে প্রায় পাগল বানিয়ে ছাড়ল-- সারাজীবনের যা লেখা তার অর্ধেক এ-কাগজ সে-কাগজ থেকে সংস্থান করা যাবে হয়ত-- এরপরও কম করেও গত দু'বছরের আঠারটি অপ্রকাশিত গল্প জীবন থেকে একেবারেই হারিয়ে গেল-- এর এক-আধটি হয়ত কোনো-কোনো ছোটকাগজ ছাপবে, কিন্তু তার সংখ্যাও নেহায়েত পাঁচের অধিক নয়-- তেরটি গল্প লেখা কি সোজা কথা-- এ কষ্ট সওয়া যায় না-- বসটা একটা পাগলা কুত্তা-- প্রায়ই এসব ভাবে আর ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে ওঠে অমিত কহ্লার-- অথচ করার তার নেই কিছুই

অ্যাড লিঙ্ক থেকে আলাদা হবার পর থেকে মাথার ভিতরে অজস্র লেখার খসড়া তৈরি হয়ে মাথায়ই মিলিয়ে যেতে থাকল তার, কিন্তু গত দু'মাসে একটিও গল্প লেখা তার পক্ষে সম্ভব হলো না-- ইতঃপূর্বে গল্প পাঠাব বলে যেসব ছোটকাগজকে কথা দেয়া হয়েছে-- তাদের উপর্যুপরি চিঠি তাকে আরো বেদনার্ত করে তুলল-- কিন্তু তবু, কলম সহযোগে একটি গল্প কীভাবে লেখা যেতে পারে এটা এখন সে ভাবতেই পারে না-- এতবড়ো গাদা-গাদা উপন্যাস স্রেফ কলম কষে কীভাবে যে লিখেছেন আমাদের ঔপন্যাসিকগণ-- আরো কিছুদিন পর এসব নিয়ে বিস্ময়ের আর শেষ থাকবে না বলে মনে হয় তার-- জাদুঘরে রক্ষিত হাতে লেখা এসব উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি স্বচক্ষে প্রদর্শনের পরও অনেকে বিশ্বাস করতে চাবে না যে আসলেই সেসব হাতে ও কলমে লিখিত হয়েছিল-- মাত্র বছর দুয়েকের কম্পু-অভ্যস্ততা কলমের ব্যবহার তাকে প্রায় ভুলিয়েই দিয়েছে-- নিজের এত টাকা নেই যে, একটি কম্পিউটার কিনে নেয়া যায়-- তাছাড়া বন্ধুদের মালিকানায়ও নেই কোনো কম্পিউটার যে রাত জেগে তাদেরটা ব্যবহার করবে-- অমিতের মনে হতে থাকে যে সে আর কখনো লিখতেই পারবে না-- পাঠকরা তাকে ভুলে যাবে-- সম্পাদকরা তার লেখা চেয়ে আর চিঠি লিখবে না-- তার আশঙ্কা হয়, হাত না থাকায় দিনে-দিনে তার সেই স্বপ্নের মতো মুখটাও নাই হয়ে যাচ্ছে এখন

বিকল্প একটা জবও দরকার তার-- কিন্তু অ্যাড লিঙ্ক ছেড়ে দিয়েছে জানিয়ে বাবাকে একটি চিঠি লেখার পর বাবা যে সহৃদয় মতামত জানিয়েছেন, তাতে নতুন একটি কাজের জন্যে একেবারে হন্যে হয়ে পড়বার মতো কারণ তার ঘটে নি-- বাবার চিঠির মতে শেষপর্যন্ত চাকুরি না করে জেলা শহরের বাড়িতে ফিরে গেলেও বাবা তাকে সাদরে গ্রহণ করে নেবেন-- কাজেই কোনো অর্থগৃধ্নু বসের অধীনে কাজবাজ সে করবে না, এটা প্রায় সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছে-- কমবেশি খেয়ে-পরে বাঁচার উপায় তার এখনো আছে, কিন্তু গল্প লিখতে না পারলে যে তার খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটা একেবারেই অর্থহীন, এটা আর কাউকেই বোঝানো যাবে না-- বোঝানো যায় না

অভ্যাস যে বদলায় এটার একটা উদাহরণ আমি নিজেই, অমিত ভাবে-- একসময় তো আমি কলমেই লিখতাম-- এখন পারব না কেন-- আবারো পারতে হবে-- মুখ রাখতে চাইলে আমাকে পারতেই হবে-- এরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে সে হুড়মুড় করে বিছানায় এলানো অবস্থা থেকে উঠে টেবিলে বসে-- কাগজ কলম টেনে নেয় ও শুরু করে, কিন্তু পৃষ্ঠাতিরেক এগোবার পর যখন গল্পটি চরম উৎকর্ষের দিকে ধাবিতপ্রায়, তখন তার মনে হয়, আর বুঝি এগোনো সম্ভব নয়-- তাছাড়া শুধু কি একবার এগোনো-- তার খসড়াপ্রবণ রচনা কলমে অন্তত তিন তিনবার ফ্রেস করার দরকার হয়-- সেটা বেশ আয়াসসাধ্য-- নিরুদ্যম হয়ে কাগজ কলম ফেলে রেখে আবারো ফিরে যায় সে বিছানায় এবং কেঁদে ফেলে-- একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েও যায়

পরদিন সকালে ডাকে আসা নতুন চিঠিটি পড়া শেষ করে তার মনে হয়, যেকোনোভাবেই হোক তাকে আবার লিখতে হবে-- পত্রকার তার অপরিচিত একজন পাঠক, পাঠ-অভিব্যক্তি লিখতে গিয়ে তিনি এমন এক ভাষার আশ্রয় নিয়েছেন, যা একজন লেখকের অন্তর্দেশকে হ্লাদিত করবার ক্ষমতা রাখে, এতদিন সে অন্যদের হ্লাদন করেছে, আজ সে নিজেই হ্লাদিত-- তার মনে হতে থাকল, ভেতরে বুঝি একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে, যা প্রলয়ঙ্করী-- গলতে থাকল ইচ্ছা ও ক্ষমতার মধ্যকার বাধার বিন্ধ্যাচল-- ঢেউ উঠল মনে-- তক্ষুনি কাগজ কলম টেনে নিল সে এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল যে, বাক্যের পর বাক্য তার কলম থেকে নিঃসৃত হচ্ছে ঠিকই, তবে সৃষ্টিধারার গতিমুখ মোটেই একটি গল্প হয়ে ওঠার দিকে ধাবিত হচ্ছে না

Monday, January 28, 2008

বাতাসের কাজবাজ চিরকালই এই

মাগী, ফাজলামি রাখ-- দিবি যদি দে, ছেনালিপনার আর জা’গা পাস না, এমনে ত দেহি রাইত নাই দিন নাই শালার পৌষ মাসেও শন শন, বাপ-মেয়ে ঘরে বসা ত জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে বাতিটা নিভিয়ে দিলি দপ্, পিচ্চি পোলা থালায় করে মুড়ি খাচ্ছে ত উড়িয়ে নিয়ে গেলি ঝর, লাজুক মেয়ে পথ হাঁটছে ত লোকজনের সামনে ওড়না ধরে দিলি টান ফাৎ, বৃদ্ধা আয়া উঠান ঝাট্ দিচ্ছে ত পেছন থেকে কাপড় উঠিয়ে দিলি ছ্যাৎ-- কোন্ দুষ্টামিটা তুই না করলি বল, একবার পারলে সুলেমান বাদশার কাছে নালিশেও রাজি, তা তুই করলিটা কী, না-হয় একজন জীবন যন্ত্রণায় কাতর, তা বলে দম বন্ধ হয়ে সে মরতে লাগবে তুই দেখবি না, এমনটা ত হয় না, তাছাড়া, দেখবি ত চুতিয়া দোষটা কার

তেইশ বছরের যুবকের বাপের সাধ্যি কী ছিল তোর সাহায্য ছাড়া তেইশ দিন বাঁচে, ছেনালিপনা করবিই যদি আঁতুড় ঘরে করতিস, আগুনে সংসারে তার পা-ই পড়ত না

সবই ঠিকঠাক ছিল, গণ্ডগোলটা বাঁধাল শালার বাপে, ধর্মকর্মে উন্মত্ত হয়ে কে জানে কোন্ ফাঁকে সবটা কাণ্ডজ্ঞান ভর্তা করে খেয়ে বসে আছে, এখন শূন্য টাকশাল নিয়েও অযথা প্রজাপীড়ন, হারামি, মানুষ ত একটু রয়েসয়ে একটা কাজ করে, তা-না, যেন সে একটা যন্ত্র

তেইশ বছর হিমালয় থেকে শীতলতা এনে জীবনে পরিপুষ্টি দিয়েছিস, সঙ্গে এনেছিস পুষ্পগন্ধ, আর আজ চোখের সামনে একজনের ফুসফুস নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে, তুই আরামসে কলতলার নারকেল গাছের পাতা দোলাচ্ছিস-- শালী

বলি ও মাগী, যে বানচোত গণ্ডগোলটা বাঁধাল, হে কি তর দ্বিতীয় তরফের লাঙ অয়

উৎকেন্দ্রীকতারও এক কেন্দ্র থাকে নিচে

পেছনে তাকাবার আর ফুরসৎ নেই, কিংবা ডানেবাঁয়ে, শুরুর উচ্ছ্বাস আমি হারিয়েছিলাম জানি এইভাবে একবার, লালবাগ রোডে--- সেটা সেক্সের প্রশ্ন ছিল না, নয় থমকে থাকারও

শাহবাগ থেকে শুরু করি শেষে মনখারাপের কথা তুলে, যেহেতু বেশি বেশি অতিপরিচিত মুখ চোখে লাগে, অচেনা নন্দন পানে নীরবে তাকিয়ে শুধু দূর ছবি আঁকি তাই, শূন্যে সমীপবর্তী রেখে মন, স্মৃতিতে জুড়তে থাকি হাড়মা'স শিল্প মনোলোভে--- এটা এতটাই স্বপ্নসঙ্গত যে মনোযোগ গেঁথে গিয়ে চিরকেলে আত্মীয়কেও ফেলে রেখে যাচ্ছি বলে মনে হয়--- নাড়ি ছিঁড়ে

বাপু এগোও তবে রয়েসয়ে--- বলল সে, মনে রাখতে হবে যে রোপণও একটা কলা, এরও কিছু কানুনধর্ম আছে, সবাই জানে না, জানে উত্তুরে হাওয়া--- আমি বলি যে আমারো একটা ছে আছে জগৎব্যাপারে--- তুমি খুব অনিবার্য হয়ে গেছ, তুই গেছিস হয়ে, আপনি গেছেন

একমাত্র লেহনাকাঙ্ক্ষায় আমি জন্মি নি যে খানিক টকের ঝাঁঝ মুখে দিয়ে, নাক টিপে ফের তা বের করে বাঁ'হাতে আঘাত ঠুকে বলে দেবে--- 'রে তুই ফিরে যা রে আবেগপ্রবর', মেঘের দেখা আমি এটাই প্রথম পেলাম তা তো নয়, বিবিধ মাপের মেঘ শাদাকালো, বিশাল আকাশে ঢের লোফালুফি খেলে--- আপনি তো কালো মেঘ, বজ্রসম্ভাবী আধুনিকা, কিছুটা পুরুষালি ঢঙ, কাঁধেতে মোরগফুল জটাজুটে বেঁধে রাখা আছে--- তবু আমি পুড়ে যাই কেন যে ক্লিশে বিরহের ভারে

'বাংলা শব্দের বিবিধার্থ মানে আছে'র চেয়ে এ বেলায় আর কী বলা সঙ্গত বলুন, তবু প-এ প্রেম না বুঝে আপনি যে প্রতিশোধে পুড়ে যান, আমি সেটা জানি, তবে কী কী যুক্তিতে আপনি এ শুভে অনিচ্ছা করেন, সেসব জানারও আমি অধিকার রাখি

তোমাকে ফ্রড বলতে পারে শুধু আরেক ফ্রডই--- সম্মোহনশীলা ওহে দাহনবিদ্যাপটু, চিরহরিৎ সুবর্ণ সর্পিণী--- তবু শোন, নিবিড় বাজালে বাঁশি তুমি জাগবেই জানি, বহতার অক্লেশ খুনী--- দেখ, ম্যা ম্যা করতে করতে ভুলে গেছি যে, এখানেই নেমে যাওয়া হলে জানাই যাবে না কোনো হরিনাথকুল, তিলি-কি-তিসিরূপ সন্দেহ এখনো চোখের পরে নাচে--- কোন মেঘ নেব আর কোনটা নেব না তা জমিনসাপেক্ষ যদি, আমি তার নিমবার্তাবাহী

যেসব পাপকে ধর্মান্ধরাও ঠিক মনেই করে না পাপ, ওদের একেকটি মুখ মনে করে আমি বহুদিন পুণ্যের সংজ্ঞা খুঁজেছি একা, শেষে ভেবেছি এইসব শিশুপাপের মুখে হাসি ফোটাতে পারার চে' পুণ্যকর্ম কিছু ব্রহ্মাণ্ডে থাকতে পারে না, যেহেতু আরো ঢের জন্ম হবে পৃথিবীতে--- সবিশেষ পাপের সন্তান

মাইরি আমি লাগাতে চাই নি দ্বার, চিইইইই... বাতাস লাগাতে চাইল বলে, লেগে গেল, শোনো, পৃথিবীরও থাকে মোট দুইখানি দ্বার, একটা তোমার, আমি যেটা খুলি তার উচ্ছ্বাস সুশালীন--- লঙ ড্রাইভ চাঁদনিতে হলে, কুয়াশা কেবিনও যদি ফাঁকা থাকে, জানা যেতে পারে তবে দ্বারটির মানে

নগরের অন্তর্ক্ষত হলো অ্যালিয়েনেশন, একথা মানলে ভালো, কোনোই ফিরে আসার নইলে জবাব মেলে না, অবেলায় দেখা হয় বিরূপার সাথে, শব্দটির কতরকম প্রেক্ষিত হতে পারে ভেবে, আমি এমন রোমাঞ্চিত হয়েছি যে সাহস করে আকাশের তারা গুনবার মতো একটা ফ্যান্টাসিকেও মনে করেছি কর্ম, আর দারুণ রটিয়ে গেছি ঘরভর্তি আমি ফুটিয়ে রেখেছি খাঁটি কার্পাস তুলো, তুমি শুনলে হাসতেও ভুলে থাকতে পার--- হাসার সময় পেরিয়ে কমসেকম তিরিশ সেকেন্ড, আর এরকম সংক্রামক হাসি যে কী ভয়ানক হাস্যোদ্রেক করে, তা বলতে গেলেও আরেকবার হাসি পায় দ্রুত

রাতে ট্যাপের গালফুলানো শব্দ শুনলে মানুষের নানারূপ কাণ্ডকীর্তির কথা মনে হয়, এসবকে জীবনঘনিষ্ঠতা বলে যারা চ্যাঁচাবে আখেরে, তাদেরকে লোকেরা অপবাদ দেবে স্রেফ সমালোচক বলে, মজা হলো--- শব্দটা যে একটা মোক্ষম গালি, এটা জেনেও তারা গালাবাদ করে, কেননা গালিপ্রুফ মন না হলে কেউ কখনো পারে না হতে সম-আলোচক

এই যে একা আমি, তারও এক বন্ধু ছিলেন চলচ্চিড়িয়া, ঠিক বৃষ্টি যেন মেঘ না চাহিতে, ভালোবাসতেন--- হাঁটতে বলার আগেই পা বাড়িয়ে দিতেন সামনে, হাতে তাক তো এইমাত্র বাহুর যোজনা, ঠোঁটে ঠোঁট তাকালেই চোখে, নিম্নাঙ্গে তাকাবার আগেই কী যে বলে বসতেন তবু--- শুতে আমার একদম ইচ্ছে হচ্ছে না গো, যদিও শোয়াটোয়া ব্যাপারে আমার অ্যালার্জি নেই, ছিল না কস্মিনে--- শুনে বেশ কাতুকুতু লাগে, যেন শোয়া ছাড়া মনুষ্যাভিধানে কোনো প্রীতিকেলী নেই--- যেন ঘর মানেই হলো বিছানা আর বাহির মানে পথ

সত্যবাদিতা বেশ তোহফা কাজ, সত্য চিনতে হলে যে ক'টা মিথ্যের ঘাড় চিবিয়েচুনিয়ে খেতে হয়, কোয়ান্টিটির ভ্যালু সেখানে ওঠাতে হলে, কারো না কারো দ্বার, খোঁয়াড়ের, ভাঙানোই লাগে, এত এত ঘাড়বান মোরগেরা থাকে না যত্রতত্র সকল খোঁয়াড়ে--- তবু এটা নিঃসন্দেহে এক সর্বনাশা কথা যে, অহেতু গুঞ্জন খাড়া করে নিজে নিজে দ্বার খুলে পালিয়ে যাবে কোনো গানগাওয়া পাখি, মানবে না এটা কোনো পরিবেশবিদই, কেননা পক্ষীকুলের শাশ্বত জীবন দেবে, এমন খোঁয়াড়ঘর ভূ-ভারতে নেই, আছে শুধু মনের ভারতে

আমি বাংলাভাষার হয়ে ওকালতি করি, এটা মনে রেখেই যারা ছোটবোনের নোটবুকে ইংরেজিতে লেখে নিজ অ্যাফেয়ার্স নোট, তাদের সখ্যলাভ বিষয়ে তীব্র উচ্চাশা পোষণের রেওয়াজ সমাচ্চলিত আছে--- যেটুকু সন্দেহ এতে লুকিয়েচরিয়ে থাকে, তার চিরন্তনতা ব্যাপারে সন্ধিগ্ধ বলে অনুমান শব্দটাকে আমরা ঢের আমল দিয়েছি কালে কালে--- শিল্পের এহেন ঘোর, রতিকল্পধারা, বেয়ে বেয়ে, আগুয়ান হতে হতে আনকোরা একেকটা ইমেজারি গড়ে তুলে পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু হাস্যলাস্য করি, আমরা, মনে মনে

যতসব ফণিমনসা কাঁটা, শরীরে বিঁধতে থাকে বনব্যর্থপুরে--- কতদূর চলে গেছে সাফল্যচরণ দাশের হরিদ্রাভ বাড়িটির পথ, যেখানে শীতের সকাল রৌদ্র পোহাতে আসে খেজুরের গুড় মুড়ি নিয়ে--- তুমি ও হৃদয়ধারীর সাথে হেঁটে হেঁটে খুঁজে দেখতে হবে

তবু যদি ব্যর্থতা সঙ্গ নাহি ছাড়ে, ওয়েস্টপ্লাজার ঘাসে একদিন একা বসে কেঁদেকেটে আসা যেতে পারে, তবে কিছু নাগরিক গ্লানি ভোলা যাবে--- নগরের সবচে' সত্য তো হলো ডাস্টবিন, এরকম বিন দেগে দেগে স্থাপনা কল্পিত হয় নগরভুবনে, বয়সের আন্দাজ করি তাই সভ্যতার দৈর্ঘ্যপ্রস্থ মেপে--- আমি আর পাড়াতুতো রুচিরা স্বজন

ময়ে যদি ডাস্টবিনে চলে যাই, মনে করো আমি সভ্যতা নই, সমান্তরালে বেড়ে ওঠা তার উপজাত শুধু, মানে বাই-প্রোডাক্ট, পেছন পথে আসা, তুমি তাই-ই ঠাহর করেছ

এই রচনাটি কোনোই গণিতসূত্রের ওপর আপতিত নয়

ইতঃপূর্বে সাড়া প্রদান করেও গ-এর মনোসূত্রের সুতীব্র টান উপেক্ষা করে খ-এর মৌনাবেগে উসকে ওঠা অভিমানকে প্রশ্রয় দিতে ক এসে যখন দাঁড়াল রোদ-চশমায় মোড়িত অপরাহ্ণের গোটাটা জুড়ে, তখন ঘ-এর দেহস্থ পরিচ্ছদগুলো বহুবর্ণা পাখি হয়ে আকাশে উড্ডীন-- ঘ কেননা দেহ-নন্দনেই আঁকতে চায় গ-এর প্রেমাচ্ছন্ন মনের পটে অনশ্বর এক শিল্পিত আঁচড়

খ চায় না ক গ-এর দিকে হাঁটুক-- ক চায় বটে, কিন্তু সে বেচারী যথার্থেই স্বাধীনতা থেকে দূরে অবস্থান করে, সংঘাতটা কাজেই তার সামাজিক-লৈঙ্গিক মতবাদের নিচে সমাহিত

গ ঘ-এ চড়েও ক-এ মুগ্ধ-- কখ-এর সম্পর্ক তাই স্বতোকম্পমান, যেহেতু ক দোলনরত উত্তর-পূর্বের ঈশান কোণ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের নৈর্ঋত কোণে

আর যত আগামীকাল, ক কি আড়ালকেই জ্ঞান করবে না ঈশ্বর এবং খ-এর শিকলে শৃঙ্খলিত হয়েও কি সে গ-এর প্রান্তরে এসে ঠুকবে না দ্বার, যতই ঘ-এর সুঢৌল মেদ অহোরাত্র পাহারাপ্রণীত থাক গ-এর যৌবরাজ্যে-- আর স্বরচিত সংশয়গাছের আগায় চড়ে চুপিচুপি প্রতিবেদনভাষ্য রচনা করা ছাড়া খ-এর তখন কী এমন করণীয় থাকা সম্ভব

পায়ে এসে ঠেকে অদৃশ্য মৌলকণা-- কুয়াশার হাড়গোড়

গুহাজাত অন্ধকারের একটা মাঝারি টুকরো হামাগুড়ি দিয়ে এসে সদর রাস্তায় পড়তেই, বায়ুসমুদ্রে বিরাজিত শুষ্ক কণাসমূহ, স্পঞ্জের মতো শুষে নিয়ে গোটা পৃথিবীটাকে গাবগাছের ছায়ার মতো কালো করে দিল, মেঘের আড়ালে যৌবনের অমিত তেজে সে তখন খেলছিল, একাদোক্কা, সখিগণ সহযোগে, তবু স্বপ্ন গোপন করে বাহ্য উন্মাদনায় যদিও সে হাসছিল, প্রকৃতপক্ষে তার তখন অস্তিত্ব জুড়ে বেরিয়ে পড়ার তাগিদ, বাড়ি বাড়ি ফেরি করে আলো বেচাকেনা, পায়ের নিচে তিলধারী সে, সুর ভাজতে জানে, তার সুরের মদিরা গন্ধে তেপান্তরের ঘাসে মূর্ছিত হয়ে কতজন বুকে বিঁধায়েছে বেদনার শল্য... কেউ সিফিলিস... কেউ ট্রাম... সে জানে, তাই আদিখ্যেতা রেখে, থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে বরফ চূড়ায় বসে যায় ভাবনাব্যাপদেশে, সখিগণ দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরে রূপার কলস... গায়ে মাখে নিমপাতা ছেঁচা রস... বেলফুল... অতঃপর সার বেঁধে নদীমুখো হাঁটা দেয় তারা, সঙ্গে সাম্বা নাচ নেচে সে হাঁটে, জল ছোঁয়, দিগ্বলয়ে হৈচৈ পড়ে যায় আলোর নাচনে, পাতায় পাতায় বিকিরিত রশ্মিরাজি অস্পর্শনীয় মায়াবী সুতোয় হাজারটা প্রতিফলন এঁকে, শব্দিত-স্পন্দিত প্রাণের চোখে-মুখে তড়াক করে ছুড়ে দেয় প্রীতম সম্মোহন, অতঃপর সখিগণের কলরবা ঢেউ জলের নিয়মে দিগ্বিদিকে ছড়াতে শুরু করলে, স্নানের পাট চুকিয়ে সে শাদা শাড়িতে মোড়িত হয়ে পা রাখে নিজস্ব গ্রাফে, আর পৃথিবীর সব অন্ধকার গাবগাছই তখন চালতা গাছের মতো সুন্দরী হয়ে যায়...

উন্মূল নুঁড়িপাথরে ঝঙ্কার উঠিয়ে কিছুপথ হাঁটা হলে পায়ের কাছে দূত পাঠায় মেঘের দুহিতা, কালো কঙ্কন পরা অমিত বিক্রমী বলীয়ান-যে তার মহিয়সী, কেশভারানতা, পথের পাশে লভ্য আপনার ছায়ামাঝে প্রত্যাদিষ্ট সে, অতঃপর যাবতীয় বিভারাজি ত্রস্ত লুকায়ে ফেলে, এবং গীত হবে যে সুরীয় আবেশ, তার চরণকলাদের রেওয়াজের জলঝর্ণায় ধুয়ে নিয়ে যাপন করে অবসর কাল, আর তুন্দ্রায় তখন ভরাবৃষ্টি, সে বৃষ্টিময়ী, তার চিরকাল ভরাবৃষ্টিকে গানের নিচে শয্যা পেতে বাসের মতো সুখের লাগে...

পাখিগণ নীড় থেকে গলা বাড়িয়ে দেখে ক্রমদৃশ্যমান ভেজা ও বিষণ্ন নিসর্গকে, যেনো সমুদ্রের তলদেশ থেকে পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হচ্ছে ধরা, দৃশ্যাহতির এ পর্যায়ে অদ্ভুত এক আবাহনে প্রত্যেকের স্নায়ুর নদীতে অন্যরকম এক পুলক ছলকে ওঠে, আর তারা স্ব-স্ব দরজায় দাঁড়িয়ে কোরাসে গেয়ে ওঠে স্বাগতম...

সে হাঁটে, তার পায়ে এসে ঠেকে অদৃশ্য মৌলকণা, কুয়াশার হাড়গোড়, তবু শাদা, আহা শাদার আতিশয্যে ম্রিয়মাণ হয়ে যায় সব বাধা, তার কেননা জীবনই যৌবন, মুখিয়ে আছে যারা নিচে থেকে চাতকের প্রায়, তারা জানে, কত অনিয়ম তিতিক্ষার পর মেলে এই যৈবতি কন্যার মন...

কন্যা বর দিলে ফুল ফোটে, শাপ দিলে হুল, সেই-ই মাটি দেয় আগুন দেয়, টিপে-গড়ে তাপে-পুড়ে সোহাগী পুতুল, দেবী সেই-ই স্তন্যদাত্রী, লালন-পালন তার, সেই-ই যুগিয়ে যায় যাবতীয় খোরপোশ, সেবার মানস...

সমস্ত সৌরভ দিয়ে দেবী আমাকে ভালোবাসে, তার অপরিমেয় প্রেমের প্রবাহ আমার বিষণ্ন তালুক-এ বয়ে আনে উর্বরা পলি, আমি চাষে মত্ত হই, চাষী...

মিথ্যাবাদীদের জন্য অপাঠ্য রচনা

পূর্বাহ্ণে গৃহীত পরিকল্পনানুযায়ী আমাকে চারটি বিচ্ছিন্ন টুকরোয় বিভাজিত করা হলো, যার প্রতিটিই স্বয়ংসম্পূর্ণ, তারপর আমার আত্মাকে বলা হলো--- এর যেকোনোটিতে ঢুকে পড়, প্রত্যাশা পূর্ণ হবে...

আদিষ্ট হয়েই আমার আত্মা প্রথমে শিরের কাছে গেল, যা মস্তিষ্ক ধারণ করে ও জ্ঞানচর্চায় ভূমিকা রাখে--- ফিরে আসতে হলো, কারণ জ্ঞান অল্পজ্ঞানীকে অসহিষ্ণু করে তোলে ও তার কামাগ্রহকে নিরুৎসাহিত করে

আত্মা বক্ষের কাছে গেল, যা মন ধারণ করে ও ভালোবাসার দেয়া-নেয়া করে--- পিছিয়ে আসতে হলো, কারণ অশরীরী প্রেম সর্বত্র প্রশ্রয় পেলেও তা রীতিমত যাতনা-উৎপাদী

এবার উদরের কাছে যেতে হলো, যা ভোগ গ্রহণ করে ও তার সারাৎসার বণ্টন করে--- বিরূপ হতে হলো, কারণ স্থুল ভোগাকাঙ্ক্ষাই মানুষে-মানুষে হানাহানির সূচক

সবশেষে কামেন্দ্রিয়ের কাছে যাওয়া, যা অনুভূতি ধারণ করে এবং খায় কিন্তু হজম করতে পারে না--- ফিরতে উদ্যত হয়েও অব্যাখ্যাত এক অন্তর্গত টানে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা, সম্ভবত মানুষের শরীরী প্রেমাকাঙ্ক্ষা অফুরন্ত বলে, এ বিষয়ক সদ্জবাবে সকলের কণ্ঠেই দশাসই অতৃপ্তি ঝঙ্কৃত হয়